দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ঘোষিত তফসিল ঠিক থাকলে গণরায়ের আগেই ধারণা করা যায় যে, কোন দল জয়ী হতে চলেছে, কারা গঠন করবে সরকার৷ কিন্তু দশম, একাদশে ভোটের আগেই যেমন জাতীয় পার্টিকে সংসদের প্রধান বিরোধীদল হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিলো, এবার বিষয়টি কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আছে৷ এই কারণেই মনোনয়নের আগেই নির্বাচনি রেলগাড়ি থেকে পুত্রসমেত ছিটকে পড়েছেন রওশন এরশাদ৷ এই ধাপে এসে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ও জিএম কাদেরের জাপার ভোটের ‘বোঝাপড়া' কীভাবে হবে, সেটা স্পষ্ট হয়নি৷ নৌকার প্রতীকের দলটি নিজেদের প্রার্থী ঘোষণার দিন শুধু লাঙ্গলের জন্য ছাড় দিয়ে রেখেছে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন৷ যেখানে জাপা প্রার্থী দিয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে৷
পরিস্থিতি বিচারে ধন্দের মধ্যে পড়ে গেছে ১৪ দলীয় জোটে থাকা আওয়ামী লীগের ১৩ শরিকও৷ নৌকায় চড়ে ভোটের বৈতরণী পার হওয়া যাবে কি-না এ নিয়ে তাদের অপেক্ষার প্রহর যেন বাড়িয়েই চলেছেন জোট প্রধান৷ মনোনয়ন ঘোষণার শুরুতেই শুধু একটি আসন জোট-শরিকের জন্য খালি রাখে আওয়ামী লীগ৷ কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীকে ১৪ দলীয় জোটের সেই প্রার্থী হাসানুল হক ইনুর কাছেও পুরো পরিস্থিতি ‘বিভ্রান্তিকর'৷ ডয়চে ভেলের এক সাক্ষাৎকারেই তিনি জানিয়েছেন, জোটের ভোটের সব হিসাব মনোনয়ন দাখিলের আগে করে নিলেই ভালো হতো৷
জাসদ প্রধান ইনু নিজের হিসাবটা আগে বুঝে পেলেও নৌকার মনোনয়ন প্রশ্নে ঝুলে থাকতে হচ্ছে রাশেদ খান মেননকে৷ চলতি সংসদে তিনি যে আসনের সদস্য সেই ঢাকা-৮ আসনে এবার নৌকার মাঝি হয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম৷ ঢাকায় না হলে বরিশালে হবে- তিনটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান মেনন সবশেষ বলেছেন, ‘আমরা অপেক্ষায় আছি'৷ একাদশ সংসদীয় ভোটে নৌকায় চড়া বিকল্পধারা বাংলাদেশ নেতাদের অনিশ্চয়তা আপাতত তার চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে৷
এদিকে ‘কিংস পার্টি' হিসেবে এবার আলোচনায় আসা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বিএনপির আন্দোলন ফেলে আসা কল্যাণ পার্টি ভোটের মাঠে ‘ডামি', নাকি আওয়ামী লীগের ছাড়ে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাবে- তা-ও পরিস্কার নয়৷ কারণ তাদের আসনগুলোয় আওয়ামী লীগও প্রার্থী দিয়েছে৷
দ্বাদশ সংসদে সদস্য হিসেবে যাওয়ার দৌঁড়ে এখন অবধি সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তির নাম শাহজাহান ওমর৷ সমাবেশ-হরতাল-অবরোধে নাশকতার মামলায় বিএনপির অন্য শীর্ষনেতারা জামিন না পেলেও তিনি মুক্তি পান৷ এর পরদিনই বিএনপি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে৷ পেয়ে যান ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকার মনোনয়ন৷ বলা যায় নৌকা থেকে নামিয়ে দেন এবারও তার আগেভাগে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া চলতি সংসদের সদস্য বজলুল হক হারুনকে৷ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বৈধতা পেয়ে শাহজাহান ওমর যান নির্বাচনী এলাকায়৷ সেখানে নির্বাচন আচরণবিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিলে কোমড়ে পিস্তল, পাশে বন্দুক রেখে করেন সমাবেশ৷ এ অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে জেলা নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি৷ এর পরদিন শাহজাহান ওমর ঢাকায় দেখা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে৷ সেখান থেকে বের হয়ে সাক্ষাৎ বিষয়ে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাজে আচরণ করেন সাংবাদিকদের সঙ্গে৷
এর কিছুদিন আগে চট্টগ্রামেও সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে আসতে দেখা গেছে নৌকার আরেকজন প্রার্থীকে৷ সেখানে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে দলবলসহ সাংবাদিকের ওপর হামলা করেন৷ তাকে নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন বিষয়ক প্রশ্নই করা হয়েছিলো৷ সেটা শুনে আচরণের বলা যায় চূড়ান্ত লঙ্ঘনই করেন৷ এ অবস্থায় মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর মনোনয়ন বাতিলের জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি দাবি জানিয়েছে একাধিক সাংবাদিক সংগঠন৷ কিন্তু দল যেমন তাকে বহাল রেখেছে, তেমনি এরইমধ্যে তার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা৷
প্রভাবশালী-প্রতাপশালী যাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসছে, তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েই নিজেদের দায় শেষ করছে নির্বাচন কমিশনের জেলা স্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তারা৷ অভিযুক্তরাও নোটিশের জবাব দিয়েই রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন৷ বিধি লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে, কারো ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ৬ মাসের কারাদণ্ড- এমন ঘটনা দেখা যায়নি৷
দুই.
প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিহীন নির্বাচনে এবার আগেই ডামি প্রার্থীদের উৎসাহ দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের সেই ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার সমালোচনা এড়াতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ৷ ২০১৪ সালে ‘খুশিতে, ঠেলায়, ঘোরতে' ভোট দেওয়ার যে নেতিবাচক প্রবণতা- সেটাও চায় না সরকারি দল৷ চায় না ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট' জাতীয় কোনো প্রসঙ্গ তৈরি হোক এবারের ভোট ঘিরে৷
তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে বিএনপির বড় একটি অংশকে দলছুট করে ভোটে আনার বিষয়টি লক্ষ্যের আংশিক পূরণ করতে পেরেছে মাত্র৷ মেজর (অব.) হাফিজকে নিয়ে গুঞ্জন আলোর মুখে দেখেনি৷ এই নেতা নিজেই এতে পানি ঢেলে দেন৷ কল্যাণ পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম- বিব্রত করলেও বিএনপিকে বড় ধাক্কা দিতে পারেনি৷ অবশ্য এতে আপাতত আওয়ামী লীগের তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই৷ কারণ সরকারি দলের আসল প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপি যেভাবে আছে, সেভাবে তারা ভোটের আয়োজন পণ্ড করে দিতে পারবে- সেই আত্ববিশ্বাস তাদের মধ্যে নেই৷ জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি বহাল থাকায় দলটির চলতি হরতাল-অবরোধ অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে৷ বড় বড় নেতা কারাবন্দী৷ যারা বাইরে তাদের অনেকেই আত্মগোপনে৷ মাঠের রাজনীতিতে নেতৃত্বশূন্যতা দৃশ্যমান৷ একই সময়ে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে মাঠে আওয়ামী লীগ৷ আপাতত ‘ডামি', ‘কিংস পার্টি', ‘বোঝাপড়ার বিরোধী' ও প্রকৃত ‘বিদ্রোহী' নিয়ে ভোটের বৈতরণী পার হতে ব্যস্ত নৌকার মাঝিরা৷ কিন্তু দেশি-বিদেশি তদারককারীদের সামনে ভোট নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ থাকার বিষয়টি তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ যতোটা না নির্বাচন কমিশনের তারও চেয়ে বেশি সরকারি দলের৷ কারণ দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব- এটা গত এক দশকে সজোরে বলতে পারেনি আওয়ামী লীগ৷ যদিও এর জন্য বিএনপির দিকেই অভিযোগ তাদের৷ যেখানে তারা বলে থাকে, আসল প্রতিপক্ষ বিএনপি কখনো ভোটে অংশ নেয় না, আবার নিলেও মাঠে লেগে থাকে না শেষ সময় অবধি৷
যে ভোটে নৌকার বিপরীতে নেই ধানের শীষ, সেই ভোটের সময়ে নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ নিঃসন্দেহে বেড়েছে৷ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে চোখ রাখলেই এর প্রমাণ মেলে৷ কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা একই আগ্রহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে আসবে তো? নাকি আন্দোলনের মাঠের মতো ভোটের মাঠ নিয়েও অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে আমজনতার?