ক্রস ফায়ার, গুম নিয়ে সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদন
৫ এপ্রিল ২০১৭রেডিওর সাড়ে আট মিনিটের প্রতিবেদনের প্রায় পুরোটাই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্মকর্তার কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে৷ এর সঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও রয়েছে৷ প্রতিবেদনে গোপন কথোপকথনের ওই ব্যাক্তিকে র্যাবের ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ তবে কোথায় এবং কবে গোপন সাক্ষাৎকারটি ধারণ করা হয়েছে, তা বলা হয়নি৷ তারা দাবি করেছে, তাদের সোর্সকে সুরক্ষা দিতেই তারা তা প্রকাশ করেনি৷
মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ
প্রতিবেদনের শুরুতে কথিত র্যাব কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘‘যদি তাকে খুঁজে পাও, তবে যেখানেই থাকুক না কেন গুলি করো এবং তাকে মেরে ফেলো৷ এরপর তার পাশে একটি অস্ত্র রেখে দাও’’ – মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি এটাই হলো র্যাবের নির্দেশ৷
সংবাদমাধ্যমটির দাবি, ‘‘একটি গোপন আলাপচারিতায় র্যাবের এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এসব কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন৷’’
এ কথোপকথন ভিত্তিও করে সুইডিশ রেডিও বলছে, ‘‘বাংলাদেশে র্যাব কিভাবে তার টার্গেটকে অপহরণ করে এবং হত্যা করে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে হবে এবং কোন সহিংস পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে, তা র্যাব যেভাবে বাছাই করে তারও বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি৷ যারা গুরুতর অপরাধী বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু বিচারে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত কিংবা পুনর্বাসন করা অসম্ভব; তাদেরকেই র্যাবের এ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়৷’’
সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘সংলাপটি বাংলায় ছিল এবং নিজস্ব সূত্রকে সুরক্ষা দিতে এর ভাষান্তর এমন দেশে করা হয়েছে যেখানকার লোকজনের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা নেই৷’’
সুইডিস রেডিও জানায়, ‘‘আলাপচারিতা চলার সময় ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, কিভাবে র্যাব বাছাইকৃত টার্গেটকে হত্যা করে৷ কিভাবে পুলিশ অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়, কীভাবে তারা ওই টাকাগুলো অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহার করে এবং নিহতের পাশে সে অস্ত্র রেখে দেয়৷ অস্ত্র পাশে রেখে দেওয়ার মধ্য দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্য বোঝা যায় এবং র্যাব যে আত্মরক্ষার্থে এ কাজ করেছে তার প্রমাণ হাজির করা যায়৷’’
দুই ঘন্টার কথোপকথন
স্পর্শকাতর ওই রেকর্ডিংটি প্রায় দুই ঘণ্টার বলে দাবি করে সুইডিশ রেডিও৷ তবে প্রতিবেদনে মাঝে মাঝে কিছুটা অস্পষ্ট ইংরেজি বক্তব্য শুনিয়ে প্রতিবেদক ইংরেজিতে তার ধারা বর্ণনা দেন৷ বাংলায় কোনো কথা বা বক্তব্য নেই৷ সুইডিশ রেডিও দাবি করেছে, ওই র্যাব কর্মকর্তার নিরাপত্তার সার্থে তারা তার মূল বাংলা ভাষার বক্তব্য প্রচার করেনি৷ সেটাকে ইরেজিতে অনুবাদ করেছে৷ প্রতিবেদনে র্যাব কর্তকর্তার বক্তব্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে অন্য একজনের কন্ঠে ইংরেজিতে দেয়া বক্তব্য৷ সুইডিশ রেডিও দাবি করেছে যে, তারা গোপনে ধারণ করা বক্তব্য পরীক্ষা করে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে৷
সুইডিশ রেডিও আরো দাবি করেছে, ‘‘উচ্চ পর্যায়ের ওই কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায় যে, গুমকে বাস্তবায়ন করতে তিন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়৷ সেগুলো হলো – টার্গেটকে ধরা, তাকে হত্যা করা এবং মরদেহটি উধাও করে দেয়া৷’’
ওই কথোপকথনে বলা হয়, ‘‘মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে এর সঙ্গে কংক্রিটযুক্ত করার ব্যাপারে তারা কথা বলছেন৷ ওই কর্মকর্তা বর্ণনা করছেন, পুলিশ কীভাবে ঘটনার শিকার ব্যক্তি নিয়ে মিথ্যা কথা বলে৷ বন্ধুর কাছে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তারা তাদেরকে হত্যা করে৷’’
সুইডিশ রেডিওর কথিত গোপন সাক্ষাৎকারে ওই র্যাব কর্মকর্তা জানান, ‘‘গুমের ক্ষেত্রে সবাই বিশেষজ্ঞ নন৷ এক্ষেত্রে খুব সাবধানে কাজ করতে হয়৷ কোনো আলামত বা চিহ্ণ যেন না থাকে তা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হয়৷ কোনো আইডি কার্ড যেন পড়ে না যায়৷ গ্লোভস পরে নিতে হয়৷ পায়ের ছাপ যেন না থাকে তা খেয়াল রাখতে হয় এবং এর জন্য আমাদের জুতায় কাভার পরে নিতে হয়৷ আর এ অপারেশন চলার সময় ধূমপান করা যায় না৷’’
সুউডিশ রেডওি দাবি করছে কথিত ওই কর্মকর্তা নির্যাতনেরও বর্ণনা দিয়েছেন৷ তিনি জানান, ‘‘একটি অন্ধকার রুমের মাঝখানে একটি বাতি জ্বালানো থাকে আর সেখানে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে নগ্ন করে হাতকড়ায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়৷ তার গোপনাঙ্গে ইট বেঁধে দেওয়া হয়৷ নির্যাতিত ব্যক্তি একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন৷’’
সুইডিস রেডিওর দাবি অনুযায়ী, ‘‘উচ্চ পর্যায়ের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রতিদিন লোকজন গুম হচ্ছে৷ নির্দোষ ব্যক্তিরাও গুম হচ্ছেন, এভাবে যে কেউই হত্যার শিকার হতে পারে৷ রাজনৈতিক বিরোধীদের থেকে পরিত্রাণ পেতে এটি একটি উপায় হতে পারে৷ এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানোর একটি উপায় হয়ে থাকতে পারে বলেও মত দেন তিনি৷’’
সুইডিশ রেডিওর দাবি, ওই রেকর্ডিংয়ে এত ভয়াবহতার বিবরণ আছে যে ভাষান্তরকারীকে কয়েকবার উঠে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে হয়েছে৷
অ্যামনেস্টি ও সুইডিশ মন্ত্রী যা বলেন
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল লন্ডনের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওলোফ ব্লোমকবিস্ট বলেছেন, ওই রেকর্ডিং শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ভয়াবহ রকমের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কেউ এতটা স্বাভাবিক ও ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে তা শোনাটা ভীষণ হতাশাজনক৷ আমরা নিজে নিজে তা নিশ্চিত করতে পারব না, কিন্তু এটি এমন কিছু যা অবশ্যই তদন্ত করা প্রয়োজন৷’’
রেকর্ডিংয়ের ব্যক্তিকে ঊর্ধ্বতন র্যাক কর্মকর্তা বলেই বিশ্বাস করতে চান ওলোফ ব্লোমকবিস্ট৷ তিনি বলেন, ‘‘এ রেকর্ডিংয়ে আমরা র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত যা শুনেছি তার সঙ্গে কয়েক বছর ধরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রাপ্ত তথ্যের মিল রয়েছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে নির্যাতনবিরোধী ভালো আইন রয়েছে৷ কিন্তু তা কাগজে কলমে৷ সমস্যা হলো এ আইনের চর্চা হয় না৷’’ এই প্রেক্ষাপটে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷
এদিকে সুইডিশ রেডিওতে প্রচারিত প্রতিবেদনে কথা বলেছেন সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গট ওয়ালস্ট্রম৷ তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ র্যাবের সমালোচনা করে সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ সুইডিশ রেডিওর অনলাইন সংস্করণে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘‘একটি বিষয়ই বলার আছে – এটা ভয়াবহ ঘটনা এবং দ্রুত এর অবসান দরকার৷ দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশটির পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছিল সেটাই এখানে নিশ্চিত হয়েছে৷’’
র্যাবের বক্তব্য
এ বিষয়ে র্যাবের বক্তব্য জানতে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে বৃধবার র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি৷ এসএমএস পাঠিয়েও জবাব পাওয়া য়াযনি৷ তবে তিনি বুধবার বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’-কে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘র্যাব আইনবহির্ভূতভাবে কিছু করে না৷ ক্রসফায়ারে এখন পর্যন্ত যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা সশস্ত্র, কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ডাকাত ও জঙ্গি৷ ওদেরকে ধরার জন্য যখন অভিযান চালানো হয়, তখন তাঁরা র্যাবের ওপর গুলি ছোঁড়ে৷ তখন র্যাবকেও গুলি ছুঁড়তে হয়৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু র্যাবের গুলিতেই সন্ত্রাসীরা নিহত হয়েছে ব্যাপারটা তেমন নয়, র্যাবের কর্মকর্তা ও সদস্যরাও নিহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন৷’’
মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদনের কথা শুনেছি৷ কিন্তু পুরো তথ্য আমাদের কাছে নেই৷ তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি৷ তবে এটার তদন্ত হতে পারে৷ আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুরো তথ্য দিলে আমরাও তদন্ত করে দেখতে পারি৷ আগে ওই প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন৷ সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা সত্য যে সম্প্রতি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম বা নিখোঁজ বেড়ে গেছে৷ এটা মানুষকে শঙ্কিত করছে৷ আমরা এগুলো দেখতে একটা ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ করব৷ আর ক্রসফয়ারের ঘটনা যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করতে হবে৷ যদি কোনো কাজ বেআইনি হয় আর তার সঙ্গে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’