ক্ষতিপূরণ পওয়ার পথ সুগম হলো
৪ ডিসেম্বর ২০১৭২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীরসহ পাঁচ আরোহী৷ তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাগামী একটি বাসের সংঘর্ষ হয়৷ ফৌজদারি মামলা ছাড়াও ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দু'টি মামলা দায়ের করেন৷ সেই মামলার একটির চূড়ান্ত রায়ে রবিবার তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷ আগামী তিন মাসের মধ্যে বাসের মালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিকে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে৷ এর মধ্যে বাস চালক ৩০ লাখ, বাস মালিক ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ এবং রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে৷
মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালত বলেছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতরা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখন ক্ষতিপূরণ চাইতে মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী মোটরযান ট্রাইব্যুনালে যেতে পারবেন৷ গেলে ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার পাবেন তাঁরা৷ আদালতের এই নির্দেশনা এখন প্রচলিত ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি দুর্ঘটনার শিকার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথও সুগম করে দিলো৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আদালত যাত্রীদের ইনস্যুরেন্স, ইনস্যুরেন্স বা বীমা কোম্পানি, মালিক, চালক সবারই সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে দায়-দায়িত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছে৷ তাই দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ আমি মনে করি, এতে দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং সড়ক দুর্ঘটনাও কমবে৷ তবে এখন সবাইকে এই আইন এবং আদালতের নির্দেশনা নিয়ে সচেতন করতে হবে৷''
রায়ের পর চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এই রায়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো৷ এরপর কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁরাও ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন৷ কিন্তু এই রায় ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত বাস্তবায়ন করলেই বেশি সন্তুষ্ট হবো৷ আমার সাত বছরের ছেলে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷ এই রায়ে তারও কিছু স্বস্তি আসবে৷''
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত জানায়, ‘‘প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটছে৷ আমাদের দেশে ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ ১৯৮৩' নামে একটি আইন রয়েছে৷ কিন্তু ওই আইন না জানার কারণে তাঁরা (ক্ষতিগ্রস্তরা) কখনও আদালতে আসেননি৷ তবে এই রায়ের পর থেকে ভবিষ্যতে তাঁদের আদালতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলো৷ এখন থেকে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির মুখোমুখি হলে আহত ব্যক্তি তাঁর নিজের পক্ষে অথবা নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাঁর পরিবার এই আইনের অধীনে আদালতে আসতে পারবেন৷''
ওই আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করতে কোর্ট ফি-র জন্য মাত্র ২০ টাকা খরচ হয়৷ ক্ষতিগ্রস্ত যে কেউ বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ মামলা করতে পারেন৷
তবে প্রচলিত আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে যত টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ আদালতে মামলার সময় বাদীকে জমা দিতে হয়৷ তাই বাংলাদেশে খরচের কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করতে উৎসাহ পান না৷ আবার ক্ষতিপূরণের রায় পেলেও তা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে৷ এই যেমন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর স্ত্রী ২৭ বছরে লড়াই চালিয়ে আদালতের রায় পাওয়ার পরও এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে পারেননি৷
দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ১৯৮৯ সালে মতিঝিলে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন৷ এর দু'বছর পর তাঁর স্ত্রী রওশন আরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ ২০০৫ সালে সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দেয় আদালত৷ পরে ২০১৪ সালে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ৷ তবে রায় বহাল রাখলেও ক্ষতিপূরণ কমিয়ে এক কোটি ৬৯ টাকা করা হয়৷
রওশন আরা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সেই টাকাও এখনো আদায় হয়নি৷ আমি মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি৷ আদালত বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের তেজগাঁ এলকার জমি নিলাম করে টাকা দেয়ার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না৷ কারণ এর পিছনে প্রভাবশালীরা জড়িত৷ নিলামে জমির দাম ওঠে না৷ বার বার নিলাম বাতিল হয়৷ ওদিকে আমি আমার দুই সন্তান নিয়ে হুমকির মুখে আছি৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রয়াত তারেক মাসুদ পরিচিত মানুষ৷ হয়ত সেই কারণে তাঁর পরিবার ক্ষতিপূরণের রায় পেয়েছেন৷ আমি রায়কে স্বাগত জানাই, তবে অত উৎসাহিত হতে পারছি না৷ অনেক পরিবারের তো আদালতে যাওয়ারই সক্ষমতা থাকে না৷ তারা কী করবে? তাই ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা নয়, সরাসরি ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা রেখে আইন করা দরকার৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অনেক আইন আছে৷ টর্ট আইন তার একটি৷ কিন্তু এটাকে সামনে নিয়ে আসবে কে? সড়ক দুর্ঘটনা কেন, যে কোনো ধরনের ক্ষতির ঘটনায় এই আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যায়৷ কিন্তু আইনটির ব্যবহার নেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘একটি সড়ক দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে শেষ করে দেয়, পথে বসিয়ে দেয়৷ তাই রাষ্ট্রীয়ভাবেই ক্ষতিপূরণের বিধান করা উচিত৷''
প্রসঙ্গত, নিরাপদ সড়ক চাই-এর (নিসচা) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় চার হাজার ১৪৪ জন নিহত ও পাঁচ হাজার ২৫৫ জন আহত হয়েছেন৷ ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার তিনজন৷ আর ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৯২৮টি৷ এগুলোতে নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ৫৮৯ জন আর আহত হন ১৭ হাজার ৫২৪ জন৷
আদালতের এই রায় সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? লিখুন নীচের ঘরে৷