ক্ষতির মুখে চামড়া ব্যবসা
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭এই মৌসুমে ৮শ' থেকে ২ হাজার কোটি টাকার কাঁচা চামড়া কেনাবেচা হলেও এবার এরইমধ্যে ৫-৬ শ' কোটি টাকার চামড়া সরবরাহ কম হওয়ায় এই ক্ষতির আশংকা করছেন তাঁরা৷
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)-র সভাপতি শাহীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘এবার আসলে চামড়াকে ঘিরে আমাদের যে টার্গেট ছিল তা বাস্তবায়ন হবে না৷ ২০টি জেলাতে বন্যার কারণে পশু কোরবানি কম হয়েছে৷ প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় ১০ ভাগ বেশি পশু জবাই হয়ে থাকে৷ কিন্ত এবার একদিকে বন্যা, অন্য দিকে দেশের বাইরে থেকে পশু কম এসেছে৷ সব মিলিয়ে শতকরা ২০ ভাগ কম চামড়া পাওয়া যাবে৷ ''
তিনি বলেন, ‘‘এবার ৬০-৬৫ লাখ গরুর চামড়া সংগ্রহ করার টার্গেট ছিল৷ সেখানে হয়ত ৫০ লাখ পিস পাওয়া যাবে৷ ছাগল ও অন্যান্য পশুর চামড়া ২৫ লাখের মতো আশা করা হলেও ১৫ লাখের মতো আসবে৷''
এক্ষেত্রে বন্যাকেই প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি৷ এর বাইরে, কোরবানির সময় ভারত ও মিয়ানমার থেকে এই পশুগুলো আসে৷ মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই সেখান থেকে পশু আসেনি৷ এছাড়া শুধু ভারত থেকেই আসে ১৯- ২০ লাখ পশু৷ সীমান্তে ভারত সরকার কড়াকড়ি আরোপ করায় কিছুদিন ধরে সেখান থেকে গরু আসাও কমে গেছে বলে জানান শাহীন আহমেদ৷
তবে কেবল এই দুই কারণই নয়, এর বাইরেও কোরবানির আগে আগে লবণের বাজার গরম হয়ে ওঠা, রাজধানী থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেয়াসহ বেশকিছু কারণের কথা উল্লেখ করেছেন কাঁচামাল সংগ্রহকারী , আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা৷ তাঁদের মতে, এসব কারণেই চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এবার৷
এ বছর লবণ আগের বছরের তুলনায় বস্তা প্রতি ১৩- ১৪শ' টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে৷ দাম বাড়ার কারণে লবণের তীব্র সংকটে পড়তে হয়৷ যার প্রভাব পড়ে প্রাথমিক মজুতদারদের ওপর৷ ফলে আড়তদারদের কাছে তাঁরা লবণ বেশি দামে বিক্রি করেন৷ চাহিদা মেটাতে এবার সরকারকে পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানি করার অনুমতি দিতে হয়েছিল্৷ ঢাকা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম বলেন, ‘‘‘লবণের জন্য এবার যে ভোগান্তি হয়েছে তা আর কখনো হয়নি৷''
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় এবার গরুর চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম ৫০- ৫৫ টাকা ঠিক হয়েছিল৷ সেই চামড়া আড়ত মালিকরা কিনেছেন ৬০-৬৫ টাকায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়৷ আর ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকায় হওয়ার কথা থাকলেও সেটি ৫০ থেকে ৫৫, আবার কোথাও কোথাও ৬০ টাকাতেও কিনতে হয়েছে৷ অর্থাৎ সরকারের সাথে একমত হয়ে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেও সেই দামে শেষ পযর্ন্ত স্হির থাকা যায়নি৷
ঢাকায় গত পাঁচ বছরে কোরবানির গরুর চামড়ার দাম (প্রতি বর্গফুট)
২০১৩ ৮৫-৯০ টাকা
২০১৪ ৭৫-৮০ টাকা
২০১৫ ৫০–৫৫ টাকা
২০১৬ ৫০ টাকা
২০১৭ ৫০-৫৫ টাকা
ট্যানারি মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন জানায়, গত বছর ৫৫ লাখ পিস গরু, ছাগল ও মহিষ মিলিয়ে ২০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল৷ তাতে টার্গেটও পূর্ণ হয়েছিল৷ কিন্ত এ বছর আর তা হচ্ছে না৷ এবার গরুর চামড়ার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ লাখের মতো৷ একইভাবে ছাগল ও অন্যান্য পশুর চামড়াও কমেছে৷
ইটিপি স্থানান্তরের পর বতর্মানে ১৫৫টি ট্যানারির কাজ চলছে, ৫৮টি প্রাথমিক উৎপাদনে আছে, ১০টি কোম্পানি রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে৷ ইটিপি স্থানান্তরের ফলে অনেক ট্যানারি পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ব্যাংক ঋণগ্র্রস্ত হয়েছে৷
বাংলাদেশ লেদার অ্যাণ্ড গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো্. আরিফ জানান, ‘‘হাজারিবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় এবার চামড়া কেনার চাহিদা অনেক কমে গেছে৷''
ঢাকা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম বলেন, ‘‘চামড়ার দুর্দিন যাচ্ছে এখন৷ দুইশ' ট্যানারি এখনো চালু হয়নি৷ ৬৮টি প্রাথমিক উৎপাদনে গেছে৷ আমরা যারা কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করে থাকি, তারা তাকিয়ে থাকি ট্যানারির মালিক ও সরকারের দিকে৷ সরকারকে দেখতে হবে ট্যানারির মালিকরা সঠিক দামে কিনতে পারছে কিনা৷ আর তা না হলে মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া রক্ষা করা যাবে না৷''
এ ব্যাপারে তিনি অবশ্য ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে ম্যানিপুলেশনের অভিযোগও করেন৷ বলেন, ‘‘ট্যানারির মালিকরা সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়ার দাম কমায়৷ তারা যদি সঠিক দাম না দেয়, তাহলে খুব মুশকিল হয়ে যায়, যার পরিণতি সবার জন্যই খারাপ হবে৷'' ট্যানারির মালিকরা সময়মতো টাকা পরিশোধ করেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘গত বছর অনেক ট্যানারির মালিক ১০-১৫ ভাগ মূল্য পরিশোধ করেছেন৷ কোনো কোনো মালিক তো কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি৷ বাকিতে চামড়া কিনেছেন৷ অনেক ট্যানারির মালিক আমাদের টাকা-পয়সা না দিয়ে আত্মগোপনে আছেন৷''
এই অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)-র সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘‘কয়েকটা হাত বদল হয়ে আমাদের কাছে চামড়া আসে৷ ফলে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেই দামে আমরা কিনতে পারি না৷ বরং তার চেয়ে ১০-১৫ ভাগ বেশি টাকা দিয়েও আমাদের কিনতে হয়৷ বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনেছে৷ সেই সময় স্টক করে এখন তারা মুনাফা করছে৷ তারা খুব কম সময়ে তাদের বিনিয়োগ ফেরত পেতে চায়৷ তাই বেশি দামে তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে চায় তারা৷ মাঝের কয়েকটা দিন যাদের কাছে চামড়াগুলো থাকে, তারা কয়েকটা দিন চামড়া রাখে৷ আর আমাদের কাছে বিক্রি করতে বা পৌঁছাতে পৌঁছাতেই তার দাম বেড়ে যায়৷ ফলে আমাদেরকে আরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে৷ অর্থাৎ এই মধ্যস্বত্তভোগীরাই মূলত কাঁচা চামড়ার এই মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে৷''
শাহীন আহমেদ আরো বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক বাজারদর কমা চামড়ার সংগ্রহ ও ব্যবসার ক্ষতির পেছনে আরেক বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে৷ আগের বছরগুলোতে চামড়ার সংগ্রহ ভালো থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দর কমায় গত প্রায় তিন বছর থেকে লোকসানে আছি আমর৷ বিশেষত আমাদের বেঞ্চমার্ক ইউএস হাইড, ব্রাজিলিয়ান হাইডের অবস্থান যেহেতু পড়তির দিকে, ওইভাবেই বাংলাদেশকেও দাম নির্ধারণ করতে হয়েছে৷ তিন বছর ধরেই এইরকম চলছে যে, ট্রেণ্ড এখনও অব্যাহত আছে৷ ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি৷''
শাহীন আহদেম জানান, ‘‘ইউএস হাইড ২০১৩-২০১৪ সালে প্রতি কিলোগ্রামের দাম রাখতো ১০৫ ডলার৷সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০১৭-তে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০ ডলারে৷ যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পণ্যের দামও তারা অনেক কম করে নির্ধারণ করে৷''