খেজুরগুড়ের গন্ধে মাতানো শৈশব
৮ জানুয়ারি ২০১৮বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে ঋতু পরিবর্তনে, তাই শীতকাল যেন প্রায় উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ আমাদের বাড়ি উত্তরাঞ্চলে হওয়ায় শীতকালে শীতের আমেজটা ছোটবেলায় ভালোই টের পেয়েছি৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে হিমেল বাতাস যেন হাড় কাঁপিয়ে দিত৷ তারপরও শীতকালে অন্যরকম মজা ছিল৷ শীতকাল মানেই বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এক মাসের ছুটি এবং গন্তব্য মামার বাড়ি৷
সেসময়টা ছিল চিঠি লেখার যুগ৷ হাতে হাতে মোবাইল ফোন তো দূরের কথা, বাসায় বাসায় টেলিফোনও ছিল না খুব একটা৷ তাই চিঠিতে লিখে মামাদের জানিয়ে দেয়া হতো আমরা কবে, কোন ট্রেনে আসছি৷ তারপর যখন সেই দিনটি যখন এসে পড়ল, আমার আর দিদির আনন্দ দেখে কে! ভোরের ট্রেন ধরে আমরা রওনা হতাম গন্তব্যে৷ বেলা সাড়ে দশটায় পৌঁছে যেতাম গাইবান্ধা৷ স্টেশনে নেমেই দেখতাম মামা এবং মামাতো ভাই-বোনেরা দাঁড়িয়ে আছে৷
মামার বাড়িতে তো ‘ভারি মজা, কিল চড় নাই৷' তাই আমরা তখন ‘ছাড়া গরু'৷ শীতে আমার পছন্দের মিষ্টান্ন হলো গুড়ের পায়েস৷ মামি জানতেন যে ওটা আমি ভীষণ পছন্দ করি৷ তাই বাড়ি গিয়ে হাতমুখ না ধুয়েই পায়েসের বাটি হাতে বসে পড়া৷ তবে গাইবান্ধা শহর কিন্তু আমাদের আসল গন্তব্য নয়৷ গন্তব্য নূরপুর গ্রাম, যেখানে আমার নানার বাড়ি৷ দু'দিন গাইবান্ধা শহরে থাকার পরই আমরা রওনা দিতাম নূরপুরের উদ্দেশে৷ কামারপুকুর স্টেশনে নামতেই মাকে দেখে সবাই ঘিরে ধরত৷ নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মা হাঁটতে থাকতেন৷ আমার নানাকে এলাকায় এক ডাকে সবাই চিনতেন৷ রিকশাওয়ালাদের মধ্যেও তাই কাড়াকাড়ি পড়ে যেত, কারণ বড় বাড়িতে গেলে বাড়তি বকশিশ৷
রিকশায় উঠেই শুরু হতো আমাদের মুগ্ধ হওয়ার পালা৷ এ সময় কচুরিপানার ফুলে ছেয়ে থাকত পুকুরগুলো৷ কচুরিপানার ফুলগুলোর রং যে কী অপূর্ব, তা যারা দেখেনি তাদের বোলে বোঝানো যাবে না৷ রাস্তার দু'ধারে সরষে ক্ষেত৷ মিষ্টি ফুলের গন্ধে কেমন মন মেতে উঠত৷ আর কোনো কোনো জমি থেকে এ সময় কাটারিভোগ ধানের মন মাতানো গন্ধ ভেসে আসত৷ আমাদের রিকশা চলতে থাকতো আর পেছনে একপাল ছেলে-মেয়ে৷ ট্রেন স্টেশন থেকে প্রায় দু'মাইল দূরে ছিল আমার নানা বাড়ি৷ আর এই দু'মাইলের মধ্যে কিন্তু খুব বেশি ঘর-বাড়ি ছিল না৷ যে কয়টার সামনে দিয়ে রিকশা যেত, সেই বাড়ির মানুষ এসে রিকশা থামিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করতেন৷
আমাদের রিকশা পৌঁছানোর আগেই স্টেশন থেকে কেউ সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে খবর দিত৷ তাই মাঝ রাস্তায় আসতেই আমার বড় মামার ছেলেরা হাজির হয়ে যেত৷ শুরু হতো গল্প৷ আমরা এ সময় রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি পৌঁছে যেতাম৷
বাড়ি পৌঁছাতেই আমার নানি আমাদের জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করতেন৷ আমাদের রিকশার পেছনে যে ছেলে-মেয়েদের দলটা আসতো, তাদের প্রত্যেকে মা নিজ হাতে মিষ্টি দিতেন৷ আর আমরা বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই জুতো খুলে দৌড় লাগাতাম মাঠে৷ সবুজ সরষে খেতের মধ্য দিয়ে সে যে কী উল্লাস! আমাদের যা ইচ্ছে করার স্বাধীনতা ছিল এ ক'টা দিন৷ প্রথমেই ডাব খাওয়ার ধুম উঠত৷ বলার সাথে সাথে চার-পাঁচটা ছেলে কোমড়ে গামছা বেঁধে উঠে পড়ত গাছে আর টপ টপ করে ফেলত ডাব৷ আহ কী যে তার স্বাদ! ডাব আর ডাবের শ্বাস খাওয়া শেষ না হতেই খই-মুড়ি হাতে মামি এসে দাঁড়াতেন৷
এরপর দেখা গেল পুকুরে এলাহিকাণ্ড৷ কারণ মাছ ধরা হচ্ছে, জাল ফেলা হয়েছে আর বড় মাছ ধরা পড়লে সেগুলো টেনে উপরে আছড়ে ফেলা হচ্ছে৷ জ্যান্ত মাছ ধরার কী যে আনন্দ!
দুপুরে মাছ খাওয়া শেষে বিকেলে মামার ছেলের সঙ্গে হাটে যেতাম৷ সেই হাট বিখ্যাত ছিল গুড়ের জিলাপির জন্য৷ গুড়ের জিলাপি খেয়ে গুড়ের তিলের খাজাসহ নানা কিছু সঙ্গে নিয়ে মনের আনন্দে ফিরতাম বাড়িতে৷ ফেরার পথটা ছিল অলৌকিক৷ কেননা পুরো গ্রামের কোথাও তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি৷ তাই হালকা কুয়াশায় ঢেকে থাকত পথ৷
এর মাঝে মাঝে দূরে কোনো বাসায় হয়ত কুপি জ্বলছে তার আলো এসে পড়তো রাস্তায়৷ এসে খেয়ে দেয়ে খড় জ্বালিয়ে ধান সিদ্ধ করা হতো৷ শীতের রাতে সেই আগুনের পাশে বসে গল্প করাটা যে কী আরামের বলে বোঝানো যাবে না৷ গল্প শুনতে শুনতে হয়ত ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছি৷
সকালে হাক-ডাকে ঘুম ভেঙে যায়৷ কারণ খেজুরের রস এসেছে৷ খেজুরের রস যেহেতু খুব ভোরে পারা হয়, তাই সকাল সকাল খেতে হয়৷ রস খাওয়ার পরও অনেক রস বেঁচে যেত৷ এটা তখন জ্বাল দেয়া হতো৷ সেই জ্বাল দেয়া গুড় দিয়ে বানানো হত পিঠা৷ পাটিসাপ্টা, রসকুলি, দুধপিঠা, নানা ধরনের পিঠা খাওয়া হতো এ সময়৷
আমার নানাবাড়িতে কখনো মুরগির মাংস খাওয়া হত না৷ তাই শীতে রান্না করা হত হাঁস৷ আমার নানির রান্নার হাত ছিল অপূর্ব৷ হালকা মসলা দিয়েই তিনি যে কী ভালো রাঁধতেন৷ সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে৷
এ সময় মামা বাড়ি যাওয়ার আর একটা আকর্ষণ হলো যাত্রা৷ বাড়ির সামনে সামিয়ানা টাঙিয়ে চার-পাঁচদিন ধরে যাত্রার আসর বসত৷ সারা রাত ধরে চলতো যাত্রা৷ আমাদের বাড়িতেই যাত্রার শিল্পীরা খাওয়া দাওয়া করতেন৷ রাতেরবেলায় যারা অভিনয় করতেন, সকালে দেখে তাঁদের একদম চেনা যেত না৷ মামা তখন ডেকে পরিচয় করিয়ে দিতেন৷ মায়েদের পুরো গ্রামের মানুষদের আদরে আমাদের পুরোটা মাস কেটে যেত৷ পুরো বছরের চালিকাশক্তি যেন পাওয়া যেত এই একটা মাস থেকে৷
কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম যারা, তারা এখন শীতের ছুটিতে কী করে তা খুব জানতে ইচ্ছে করে৷ তাদের সবার কি শীতে গ্রাম বাংলার অপূর্ব রূপ দেখার সুযোগ হয়? তারা কি কখনো চেখে দেখেছে ভোরের শীতল খেজুরের রস?
আজকাল সবকিছুই কেমন বদলে গেছে৷ গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর পর নগরজীবনের হাওয়া লেগেছে সেখানে৷ খেজুরের গাছই তেমন চোখে পড়ে না, রস তো দূরের কথা৷ আজকাল আর খড়ের আগুনে ধানও সিদ্ধ হয় না৷ ঢেকির আওয়াজে কারো ঘুম ভাঙে না৷ বাংলাদেশের মানুষ এখন ছুটি পেলেই ঘুরতে চলে যায় দেশের বাইরে বা দেশের ভেতর কোনো রিসোর্টে৷ কিন্তু আমাদের যে শেকড়, সেই গ্রামে যাওয়ার সময় কারো হয় না, দেখা হয় না শীতের ভোরে ধানের শীষে একটি শিশির বিন্দু৷