নিজের করা দ্বিতীয় বলেই এমন এক ক্রিকেটারকে আউট করেছেন তানজিম হাসান সাকিব যার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডবল সেঞ্চুরি আছে তিনটি। এরপর শেষ ওভারে বোলিংয়ে এসে টানা স্লোয়ারে বিপর্যস্ত করেছেন ভারতীয় টেল এন্ডারদের।
এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ছয় রানের জয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখায় প্রচুর প্রশংসাও পেয়েছেন। এসব দেখে তার কাছে মনে হতে পারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা বুঝি সহজই। খেলা শেষ হওয়ার একদিন পর মাঠের বাইরে বসেই কেবল তিনি টের পেয়েছেন এটা আসলে কত কঠিন।
অভিষেকেই ভালো খেলার সুবাদে তানজিম তার নিজের সম্পর্কে অনেককেই কৌতুহলি করে তুলেছেন। এই কৌতুহল মেটাতে গিয়ে স্বভাবতই দর্শক-সমর্থকরা তার ফেসবুক পেজে ঢুঁ মেরেছেন। আর তা করতে গিয়েই অনেকে চমকে গেছেন।
তানজিমের পুরো ফেসবুক পেজই ধর্মীয় সব পোস্টে ভরা। তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। ধর্ম নিয়ে একজনের আবেগ থাকতেই পারে। এই আবেগ প্রকাশে বাড়াবাড়ি করাটাই যা সমস্যা। তানজিমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেবল সামান্য বাড়াবাড়ি নয়, কিছু কিছু পোস্ট পাওয়া গেছে রীতিমতো আপত্তিকর। নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করা, ভার্সিটির ‘ফ্রি-মিক্সিং' মেয়েদের বিয়ে করা নিয়ে তানজিম ফেসবুকে যে মন্তব্য করেছেন, সেটা অনেকের কাছে মনে হয়েছে অশালীন। স্বাভাবিক কারণেই তার এসব মন্তব্যে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আপাতত ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন তানজিম। বিসিবি তাকে সতর্ক করেছে, কাউন্সেলিংসহ অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে।
মাত্র একটা ম্যাচ খেলেই তানজিম বুঝে গেছেন জাতীয় একজন খেলোয়াড়ের ‘দায়িত্বহীন' আচরণ, কথাবার্তা কতটা বিপজ্জনক, বিব্রতকর হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তানজিম তো শুধু একা নন। নানা ধরনের দায়িত্বহীন আচরণ তার ‘বড় ভাইয়েরা' অনেকদিন ধরেই করে চলেছেন। তানজিমের ক্ষমার কথা প্রকাশের এক ঘণ্টাও পার হয়নি, আইসিসির কাছ থেকে সবাই জেনেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে টি১০ ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বেটিংয়ে জড়িছেন নাসির হোসেন। বেটিং, ডোপিংয়ে বাংলাদেশের আরো অনেকেই জড়িয়েছেন অতীতে। যদিও এটা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, অন্য দেশের খেলোয়াড়রাও এতে জড়িয়েছেন, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা অন্য দেশকে ছাড়িয়ে গেছেন বহু আগেই।
বাংলাদেশই বোধ করি একমাত্র টেস্ট খেলুড়ে দেশ যার তিন তিনজন ক্রিকেটার পর পর তিন বছর জেলে গেছে। জেলের খড়গ ঝুলছে আরো কয়েকজনের মাথায়। কিন্তু এসবে যেন কারো কোনো বিকার নেই। রুবেল হোসেনকে দিয়ে শুরু। দেশের স্বার্থের কথা বলে তাকে জেল থেকে ছাড়ানো হয়েছে। রুবেল সেই ‘স্বার্থ' রক্ষাও করেছেন ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে। পরদিনই অভিযোগকারী তার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়ে ধর্ষণের মতো সিরিয়াস একট অভিযোগকেও রীতিমতো ‘খেলো' বানিয়ে দিয়েছেন।
রুবেল-কাণ্ডে অনেকেই রগরগে প্রেম কাহিনি দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু এরপর যত সব ঘটনা ঘটেছে, তা বরং প্রেমহীন এক সংস্কৃতিরই সাক্ষী দিচ্ছে। কেউ কেউ তো কেবল প্রেমহীন নয়, হৃদয়হীন আচরণও করেছেন। রুবেলের পর যিনি জেলে গিয়েছেন সেই শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী বাচ্চা একটা কাজের মেয়েকে অমানুষিক নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে শাহাদাত আবার তার জুনিয়র সতীর্থের গায়ে হাত তুলে নিষিদ্ধ হয়েছেন। জেলে যাওয়া আরেক ক্রিকেটার আরাফাত সানীর বিপক্ষেও অভিযোগ কম গুরুতর নয়। ঘরে স্ত্রী রেখে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সানী। তার সঙ্গে তোলা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি আবার ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে পোস্ট দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে সানীর বিপক্ষে।
যৌতুক চাওয়ার অভিযোগ রয়েছে আল-আমিন হোসেন, মোসাদ্দেক হোসেনের বিপক্ষে। এই আল আমিনের বিপক্ষে বিপিএল চলাকালে হোটেলে ‘নারী অতিথি' নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও এসেছিল এক সময়। একই ধরনের অপকর্মে তার সঙ্গী হয়ে শাস্তি পেয়েছেন সাব্বির রহমানও। সেই সাব্বির যাকে এক সময় মনে করা হয়েছিল তিনি হবেন বাংলার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু একের পর এক বিতর্কিত কাণ্ডে জড়িয়ে সাব্বির শেষ পর্যন্ত হয়েছেন বাংলার উমর আকমল। প্রতিভার নিদারুণ অপচয়ের এক বড় উদাহরণ এই সাব্বির। সাব্বিরই শুধু নন, আরো অনেকেই আছেন উচ্ছৃঙ্খল ও অনৈতিক আচরণ করে নিজের প্রতি বিরাট অবিচার করেছেন। নাসিরের কথাই ধরা যাক। বিসিবি সভাপতি স্বয়ং সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, নাসির মোবাইলের ৮০টা সিম ব্যবহার করেন বলে তাকে ফোনে পাওয়া যায় না। মাঝে ইনজুরির একটা বড় ধাক্কা গেছে তার। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর কোথায় নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবেন নাসির, উল্টো তাকেও আদালতের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। অভিযোগ, ডিভোর্সের আগেই তিনি অন্যের বউকে বিয়ে করেছেন। আর এখন তো জুয়াতেই ফেঁসে গেছেন অপার সম্ভাবনাময় এই অলরাউন্ডার।
রুবেল, সানী, শাহাদাত, আল আমিন, সাব্বির, নাসিররা যেমন তেমন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা যে ক্রিকেটার, সেই সাকিব আল হাসানের বিপক্ষেও তো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অজস্র অভিযোগ। না, নারী ঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি তার নেই। কিন্তু আর যা যা আছে, সেসবও কম গুরুতর অভিযোগ নয়। পুলিশের সতর্কতা স্বত্বেও তিনি খুনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সোনার দোকান উদ্বোধন করতে গেছেন। ব্যবসায়িক লাভের আশায় শেয়ারের দলিলপত্রে স্বেচ্ছায় নিজের বাবার নাম বদলে দিয়েছেন এমন অভিযাগও আছে। জুয়াড়ির সাথে সংস্রবের দায়ে নিষিদ্ধ হওয়ার বদনামতো আছেই।
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নৈতিকতার মানদণ্ড এত নীচু কেন তা জানতে চেয়েছিলাম তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা একজন কোচের কাছে। দেখা গেল খেলোয়াড়দের ক্রিকেটাঙ্গনে যারা নৈতিকতা শেখাবেন বলে আশা করা হয়, তাদের নৈতিকতা নিয়েও ওই কোচের মনে অনেক প্রশ্ন আছে। একটা কথা সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, আমাদের খেলোয়াড়দের একটা বড় অংশ এমন একটা সংস্কৃতিতে বড় হন, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই অনুপস্থিত, নৈতিক শিক্ষা তো পরের ব্যাপার। যদিও বা কারো বাবা-মা এসব খেলোয়াড়কে শাসন করতে চান, তারা সেটা পারেন না, কারণ, অনেকেরই সংসার চলে এই সব খেলোয়াড়ের আয়ে।
এমন অনেক খেলোয়াড়ের কথাও জানা যায়, যারা হঠা' টাকা-পয়সার মালিক হয়ে নিজেদের আর সংযত রাখতে পারেন না। হাতে পয়সা আসার আগেই যারা বিয়ে-শাদীর কাজটা সেরে ফেলেন, তাদের কারো কারো পরে আর নিজের বউকে ভালো লাগে না। কিছু খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার এটাও বড় একটা কারণ বলে মনে করেন তাদের ওই সাবেক কোচ।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য শিরোনামে আসা ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ বিকেএসপির ছাত্র। সাকিব, নাসির, শাহাদাত, কিংবা হালের তানজিমকে এই প্রতিষ্ঠান ক্রিকেট যেমনই শিখিয়ে থাকুক, অন্য শিক্ষা যে খুব একটা দেয়নি সেটা তাদের নানাবিধ আচরণেই পরিষ্কার। বিকেএসপি একটি বিশেষায়িত স্কুল। অনেক বাবা-মাই তাদের ছেলে মেয়েকে এখানে ভর্তি করাতে পেরে নিশ্চিন্ত থাকেন। তাদের আশা থাকে সন্তান এখানে খেলাধুলা তো শিখবেই, সাথে লেখাপড়াটাও চালিয়ে যাবে। খুব বেশি বাবা মায়ের যে দুটো আশা পূরণ হয় সেটা এখন আর জোর দিয়ে বলা যাবে না।
বিকেএসপির সাবেক ছাত্রদের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে এখন তো এর কারিকুলাম নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। নৈতিকতার বিষয়টা যে বিকেএসপিতে একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয়না, সেটা স্পষ্ট। আরো একটা বিষয়, যেখানে তাদের গুরুত্ব দেওয়া অবশ্য কর্তব্য, সেটাও যে হচ্ছে না তানজিম-কাণ্ডে তা-ই দেখা যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানে একজন খেলোয়াড় যে ডিসিপ্লিনেই ভর্তি হোক না কেন, তার স্বপ্ন থাকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। অনেকেই সেটা করেও থাকেন। কিন্তু দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে খেলোয়াড়ী দক্ষতার পাশাপাশি আর যে জিনিসগুলো প্রয়োজন, সেটা সম্ভবত একেবারেই বলা হয় না।
বেটিং, ডোপিং ইত্যাদি নিয়ে বিসিবি থেকে সামান্য যা কিছু বলা হয় সেটাও খেলোয়াড়রা তেমন কানে তোলে না। বিমানে চড়ার পর নিয়ম করে লাইফ জ্যাকেট পরানোর কথা যেমন বলা হয়, এটা হয়ে গেছে অনেকটা সেরকম। সবাই দেখেন, শোনেন, কিন্তু কেউ মনোযোগ দেন না। বিমান আকাশে উড়ার পর সবাই যার যার মতো। বিসিবির ব্রিফিং থেকে বেরিয়ে সবাই নিজেদের জগতে ঢুকে যাচ্ছেন। কেউ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার তানজিমের মতো কেউ ‘অতি নীতিবান' হতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কেরও জন্ম দিচ্ছেন।
এসবের কারণে প্রায় সবার অলক্ষ্যে খেলাধুলার প্রতিই নেতিবাচক একটা মনোভাব তৈরি হচ্ছে সমাজে। শিশু নিপীড়ক, উৎপীড়ক, যৌতুক-লোভীদের সাথে একই ড্রেসিংরুমে দেখা হয়ে যাচ্ছে চরম নারী বিদ্বেষী কোনো একজনের। এদের থামাতে বিসিবি সে অর্থে কখনোই ব্যাপক কেনো উদ্যোগ নেয়নি। দায়সারা গোছের সামান্য যা চেষ্টা সেটাও তেমন ফল বয়ে আনেনি। দিনশেষে তাই রবীন্দ্রনাথকেই সত্য ধরে নিয়ে বলতে হচ্ছে, ‘‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।''