পোপের সফরের আগে খ্রিষ্টান পুরোহিত নিখোঁজ!
২৯ নভেম্বর ২০১৭নাটোরের স্থানীয় সাংবাদিক কামাল মৃধা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ফাদার ওয়াল্টার উইলিয়াম রোজারিও-র মুক্তির জন্য তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে ইতিমধ্যে৷ বুধবার সন্ধ্যার দিকে উইলিয়াম ওয়াল্টার রোজারিও-র বড় ভাই প্রেমল রোজারিও এবং জোনাইল ধর্মপল্লির পাল-পুরোহিত ফাদার সুব্রত পিউরিফিকেশন এ তথ্য জানিয়েছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘রোজারিও-র পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন যে, গত বছর বনপাড়া খ্রিষ্টানপল্লির মুদি ব্যবসায়ী সুনীল হত্যার কিছু আগে-পরে ফাদার উইলিয়াম ওয়াল্টার রোজারিও-র মোবাইল ফোনে একটি নম্বর থেকে ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছিল৷ ঐ ম্যাসেজে তাঁকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়৷ এ ব্যাপারে ফাদার উইলিয়াম ওয়াল্টার রোজারিও বড়াইগ্রাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন৷ কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷''
কামাল মৃধা বলেন, ‘‘সম্প্রতি সুনীল গোমেজ হত্যা মামলায় ১২ জঙ্গির নামে আদালতে অভিযোগ-পত্র (চার্জশিট) দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ৷ আমাদের সন্দেহ, এ ঘটনার জেরে জঙ্গিরা উইলিয়াম ওয়াল্টার রোজারিওকে তুলে নিয়ে থাকতে পারে৷''
পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘‘উইলিয়াম ওয়াল্টার রোজারিওকে উদ্ধার করার জন্য জেলা পুলিশের পাঁচটি টিম কাজ করছে৷ তাঁকে জঙ্গিরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে, নাকি অপহরণকারীরা তুলে নিয়েছে, নাকি তিনি নিজেই আত্মগোপনে গেছেন, এ ব্যাপারে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি৷''
তবে এ নিয়ে জানতে চাইলে নিখোঁজ ওয়াল্টার উইলিয়াম রোজারিও-র ভাই প্রেমল রোজারিও ডয়চে ভেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চাননি৷ তিনি শুধু জানান, ‘‘এ নিয়ে আমরা টেলিফোনে কারুর সঙ্গে কথা বলবো না অথবা কোনো তথ্য দেবো না৷ পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের নিষেধ করা হয়েছে৷''
এরইমধ্যে মিয়ানমার সফর শেষে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ৩০ নভেম্বর তিন দিনের সফরে ঢাকা আসছেন ‘শান্তি এবং সহমর্মিতা'-র বাণী নিয়ে৷ তিনি শুধু খ্রিষ্টানদের সঙ্গে নয়, সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন৷ কথা বলবেন যুব সম্প্রদায়, এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গেও৷ তবে পোপ তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন রাজধানী ঢাকায়৷
গত ৩১ বছরে এই প্রথম খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু বাংলাদেশে আসছেন৷ বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় তাঁর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা৷ সেখান থেকে তিনি সরাসরি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন৷ তারপর ধানমন্ডিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন পোপ৷ পরে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি৷ বঙ্গভবনেই বাংলাদেশের সিনিয়র সিটিজেন, সুশীল সমাজ এবং কূটনীতিকদের মিলিত হবেন পোপ৷
পোপের ঢাকা সফরে মিডিয়া কমিটির প্রধান ফাদার কমল কোরাইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পোপ শান্তি এবং সম্প্রীতির বাণী নিয়ে বাংলাদেশে আসছেন৷ তিনি সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন৷ তরুণ এবং যুবকদের সঙ্গে কথা বলবেন৷ সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে শান্তি এবং সাম্যের কথা ছড়িয়ে দেয়াই পোপের এই সফরের উদ্দেশ্য৷''
সফরের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর শুক্রবার, সকাল ১০টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে খ্রিষ্টধর্মীয় উপাসনা ও যাজকদের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন পোপ ফ্রান্সিস৷ এরপর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকায় ভ্যাটিকান দূতাবাসে পোপের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের কথা রয়েছে৷ বিকাল ৪টার পর ক্যাথিড্রাল পরির্দশন করবেন তিনি৷ পরে প্রবীণ যাজক ভবনে বাংলাদেশের বিশপদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করবেন পোপ৷ বিকাল ৫টার পর কাকরাইলের আর্চ বিপশ হাউজের মাঠে শান্তির জন্য আন্তঃধর্মীয় সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন পোপ৷ এখানেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলার কথা রয়েছে পোপের৷ তবে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢাকায় নিয়ে আসার দায়িত্ব বাংলাদেশের৷ ভ্যাটিকান দূতাবাস এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷
সফরের তৃতীয় দিন ২ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ১০টায় তেজগাঁও মাদার তেরেজা ভবন পরির্দশন করবেন পোপ ফ্রান্সিস৷ সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে তেজগাঁও গির্জায় যাজক, ব্রাদার-সিস্টার, সেমিনারিয়ান ও নবিশদের সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন তিনি৷ সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে তেজগাঁও কবরস্থান ও পুরনো গির্জা পরিদর্শন করবেন৷ তারপর বেলা সাড়ে টার দিকে দিকে ঢাকার নটরডেম কলেজে যুব সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন৷ এ দিনই বিকাল ৫টার পর রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন পোপ ফ্রান্সিস৷
ফাদার কমল কোরাইয়ার কথায় পোপের সফরসূচি লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ‘‘পোপ তাঁর অধিকাংশ কর্মসূচিই রেখেছেন অন্য ধর্ম এবং তরুণদের সঙ্গে৷ তিনি নটরডেম কলেজে তরুণদের শান্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন৷''
গত দু'দিনে মিয়ানমারে পোপ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বললেও রোহিঙ্গাশব্দটি এড়িয়ে গেছেন৷ বাংলাদেশেও কি তিনি তাই করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কমল কোরাইয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে মানবিকতা দেখিয়েছে, তার প্রশংসা করবেন পোপ৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়ার যে কথা বলেছেন, তা অবশ্যই পোপের প্রশংসায় স্থান পাবে৷ আর এই সমস্যা সমাধান করে সব ধর্মের প্রতি শান্তির আহ্বান জানাবেন তিনি৷''
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশের চেষ্টা থাকবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানের পক্ষে পোপের অবস্থান নিশ্চিত করা৷ বাংলাদেশ আশা করছে পোপের এই সমর্থন পাওয়া যাবে৷'
এ বিষয়ে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতা ও শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘পোপের এই সফর ধর্মীয় শান্তি ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখবে৷ কিন্তু মিয়ানমার সফরে তিনি রোহিঙ্গাদের কথা বলতে গিয়ে কৌশল অবলম্বন করেছেন৷ এটা আমাকে দুঃখ দিয়েছে৷ পোপ তো বিতর্কের ঊর্ধে৷ তিনি তো সব সময় নির্যাতিত মজলুমের পক্ষে কথা বলেছেন৷ কিন্তু এবার কেন সেভাবে বললেন না? রোহিঙ্গা শব্দ এড়িয়ে গেলেন৷ আশা করি বাংলাদেশে তিনি আর কৌশল অবলম্বন করবেন না৷ রোহিঙ্গাদের পক্ষে তিনি স্পষ্ট অবস্থান নেবেন৷''
ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পোপ ফ্রান্সিসের এই সফর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের৷ অন্যদিকে ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ধর্মগুরু ও সর্বপ্রধান ধর্মপাল হিসেবে তাঁর সফর হবে ধর্মীয় গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে৷ পোপ ফ্রান্সিসের সফর উপলক্ষ্যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ৷ পোপের সফরের আগে রাজধানীতে ব্লক রেইডের মাধ্যমে তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে৷ পাপের সফরকালেও থাকবে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা৷ সফরের সব ভেন্যু এবং ভিভিআইপি চলাচলের সময় পোশাকে এবং সাদা পোশাকে পুলিশ এবং র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে৷
এর আগে ১৯৮৬ সালে পোপ জন পল (টু) বাংলাদেশ সফর করেন৷ প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছ'লাখ৷ এঁদের মধ্যে ক্যাথলিক চার লাখ৷