গণপরিবহনে বেশি ভাড়ায় অর্ধেক যাত্রী এবং পক্ষ-বিপক্ষ
২ এপ্রিল ২০২১বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, কেবল লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেই অর্ধেক যাত্রী নেয়ার নির্দেশনার সুফল পাওয়া যেতে পারে৷
মোজাম্মেল হকের সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতিও দিয়েছে৷ সেখানে গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি, গণপরিবহণের অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ, মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ারিং বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি করা হয়৷ সংগঠনটি মনে করে, এসব সিদ্ধান্ত উল্টো ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে৷
মোজাম্মেল হক বলেন, জনগণের জানমাল রক্ষা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নির্দেশনা দিয়েছে৷ কিন্তু এর ফলে জনদুর্ভোগ আরো বেড়েছে এবং সংক্রমণ আরো বেশি বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ আমরা দেখছি, কাউন্টারে কাউন্টারে যাত্রীদের ভিড়, বাস স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের জটলা৷ ফলে সংক্রমণ আরো বেশি বাড়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে৷
কার্যকর বিকল্প কী হতে পারে- এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এই মহাসচিব বলেন, সাধারণ ছুটি ঘোষণা না করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ‘যত সিট তত যাত্রী’ নিয়মে যাওয়া যেতে পারে৷ অর্থাৎ বিআরটিএ নির্ধারিত ‘যত সিট তত যাত্রীতে’ যদি আমরা চলে যাই এবং আগের ভাড়ায় ফেরত যাই, এতে করে দুটো লাভ হয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের উপর আর্থিক চাপ পড়বে না, পাশাপাশি যাত্রী ভোগান্তিও কমবে৷
তিনি বলেন, এখন অর্ধেক যাত্রীর নিয়ম চালু করার কারণে বেশির ভাগ যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গণপরিবহন পাচ্ছে না৷ কেউ হেঁটে যাচ্ছে৷ কেউ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে৷ তাদের মধ্যে নারী-শিশুও রয়েছে৷ অসুস্থ রোগী ও আক্রান্ত ব্যক্তিও রয়েছে৷
‘‘তাই আমরা বলছি, যত সিট, তত যাত্রী উঠবে৷ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি থাকবে৷’’
তার মতে, গণপরিবহণ চালাচ্ছে আসলে শ্রমিকরা৷ মালিকরা তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রতিদিনের লাভের টাকা গোনে৷ এই অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব নয়৷ এই দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে৷ কারণ, আমরা এখানে ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে, সেটার মূল্য অনেক বেশি৷’’
এ জন্য বেকারদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি৷ তিনি বলেন, সরকার এক্ষেত্রে বেকারদের কাজে লাগাতে পারে৷ এদেরকে সারা দেশে সংগঠিত করতে হবে৷ স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি-না, সেটা তারা নিশ্চিত করবে৷
‘‘একজন যাত্রী বাসের হ্যান্ডেল ধরার পর সেটা স্যানিটাইজ করা উচিত৷ একজন যাত্রী আসন ছেড়ে উঠে যাওয়ার পর সেটা স্যানিটাইজ করা উচিত৷ বর্তমানে যাত্রী অর্ধেক কমানো হলেও এগুলোর কিছুই করা হচ্ছে না৷ প্রতিদিন যাদের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়ছে, তাদের অনেকেই গণপরিবহণ ব্যবহার করে করোনা পরীক্ষা করতে যায় এবং ফিরে আসে৷ কোনো বাসে এরকম কেউ থাকলে পুরো বাসের সবাই সংক্রমিত হতে পারে৷’’
অর্ধেক যাত্রী তুলে বাসে স্বাস্থ্যবিধি পূর্ণরূপে মানা হলে সেটা ভালো হতো বলে স্বীকার করলেও তিনি বলছেন, এটা বাংলাদেশে বাস্তবায়নযোগ্য নয়৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিস আদালত ৫০ ভাগ জনবল দিয়ে চালাতে বলা হয়েছে৷ এরা কিন্তু গণপরিবহণের বড় ব্যবহারকারী নয়৷ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বা ছোট ছোট খাতে কর্মরতরাই গণপরিবহণের ৮০শতাংশ ব্যবহারকারী৷ তাই অফিস-আদালত, কলকারখানায় জনবল অর্ধেক করে গণপরিবহণে অর্ধেক যাত্রী নেয়ার মাধ্যমে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়৷
তবে মাঠঘুরে দেখা গেছে, সরকারি নির্দেশনায় গাড়ির ভেতরের পরিবেশ উন্নত হলেও যাত্রীদের অভিযোগ গাড়ি না পাওয়া ও ভাড়া নিয়ে৷
গৃহিণী শিউলি আক্তার বলেন, ‘‘এখন দেখেন, বাসের মালিকদের লস নেই, ওরা তো লাভবানই৷ লস তো আমাদের৷ আমাদের টাকা দিতে হয়৷ এটা তো বড় সমস্যা৷ ওনাদের তো কোনো সমস্যা নেই৷ ওনারা দুই সিটের ভাড়া এক সিটের যাত্রীর কাছ থেকে আদায় করে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এখন কী বলবো, দেশের পরিস্থিতিও তেমন একটা ভালো না৷ সিকিউরিটির দিক থেকে ভাবলে আবার ঠিকই আছে৷ কিন্তু কয়জন এ রকমভাবে চলছে? বাসে উঠার সময়েই শুধু এ রকম হচ্ছে৷’’
কাপড়ের ব্যবসায়ী পারভেজ সরকার বলেন, ‘‘আমি মনে করি, খারাপই হইছে৷ এই যে একজন করে বসতে দিতাছে, এখন গাড়ি পাই না৷ পারাপারি উরাউরি (তোড়জোড় হুড়োহুড়ি) কইরা আমরা গাড়িত উডি৷ এটা আরো খারাপ অইছে না? গাড়িই তো পাই না আমরা৷ রাত্র ৯টার পর সিরিয়ালে বইসা পারাপারি কইরা উঠতেছি৷ এতে (করোনা) বাড়তেছে না আরো?’’
‘‘সিঙ্গেল সিটে বসতে দিছে, এটা এক ভালো৷ কিন্তু গাড়ি যে পাই না?’’
নতুন নিয়মে চালকদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি৷ তারা এই নিয়মে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷
রজনীগন্ধা গাড়ির চালক নুর ইসলাম বলেন, ‘‘আমরাও গাড়ি চালিয়ে মজা পাই৷ যাত্রীরাও সুন্দর একটা শৃঙ্খলায়… যেমন এই জায়গায় ব্রেক করছি৷ যাত্রী উইঠা সিটিং হইয়া যায়, টাইন্না যাইগা৷ মোটামুটি আমাদের জন্য ভালো৷ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সবাই৷ দেশের অবস্থাবুঝে এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যাত্রীর দুর্ভোগ হইবোই৷ এটা সমাধান করতে হলে কোনো কোনো অফিস বন্ধ রাখতে হাইবো৷ তাহলে যাত্রী দুর্ভোগ হইবো না৷’’
অন্য প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আগে মনে করেন, যেখানে এক হাজার টাকা পেতাম, এখন সেখানে ২০০টাকা কম পাই৷ কিন্তু স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে আমাদের জন্য ভালো৷ তখন আমাদের গাড়িতে ১০-১২জন দাঁড়িয়ে যেতো, এখন যেভাবে যায়, তাতে আমাদের জন্য ভালো৷’’
অনাবিল গাড়ির চালক মোহাম্মদ মামুন বলেন, ‘‘পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের দিক দেখলে এটা ঠিক আছে৷ যেহেতু গণপরিবহণ৷ এখানে হরেক লোকের মেলা৷ এখানে চাপাচাপি করে লোক না উঠিয়ে অর্ধেক সিটে যাত্রী নেয়ার নির্দেশনা করোনা দমনের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী৷ পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়, যেটা ড্রাইভার হিসাবে আমিও দেখতেছি৷’’
‘‘গতকাল প্রতি স্টপেজে ৫০ থেকে ১০০ জন যাত্রী দাঁড়ানো ছিল, যাদেরকে আমরা নিতে পারিনি৷ এক সময় দেখা যায়, তারা উশৃঙ্খলতার চেষ্টা করে৷ তাদের ভোগান্তি বেড়েছে৷ অনেকে নতুন ভাড়া দিতে প্রস্তুত না৷’’
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় এমন একজন মোটর সাইকেল রাইডারকেও পাওয়া যায়, যিনি রাইডিং বন্ধ করে দেয়ার পক্ষেই বললেন৷ এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ শিপলু৷ বাসা নারায়ণগঞ্জে৷ ব্যবসায় ভরাডুবির পর গত তিন বছর মোটর সাইকেলে রাইডিং করছেন তিনি৷
গাড়ি না চালাতে পারায় অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার পরও তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য এবং দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরকার খুব সুন্দর একটা পদক্ষেপ নিয়েছে৷ এ জন্য আমরা সন্তুষ্ট৷ কিন্তু আমাদের আয়ের ব্যবস্থা নিয়ে খারাপ অবস্থায় আছি৷ আমরা নিম্ন আয়ের মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান৷ আমাদের প্রতিদিন যে আয় করার সম্ভাবনা ছিল, সেটা এখন নেই৷ এ জন্য পারিবারিকভাবে আমরা বেশ সংকটের মধ্যে আছি৷’’
তার আশা, করোনা পরিস্থিতি ঠিক হলে নিশ্চয়ই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে৷