গণপিটুনিতেও ‘ইসলামোফোবিয়া’র ছায়া
২২ এপ্রিল ২০২০দেশ জুড়ে লকডাউন সত্ত্বেও লিঞ্চিং বা গণপ্রহারের ঘটনা বন্ধ হয়নি। মহারাষ্ট্রের পালঘরের ঘটনা আরও একবার তা প্রমাণ করে দিলো। তার চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, গণপ্রহার ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার। যে কায়দায় পালঘরের আদিবাসী অঞ্চলে গুজব ছড়ানো হয়েছে এবং তার জেরে গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেছে, অদূর অতীতে ঠিক তেমনই চিত্র দেখা গিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থান-- আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ঠিক এ ভাবেই গুজব ছড়ানো এবং গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে ছোট করে পালঘরের ঘটনাটি জেনে নেওয়া যাক। গত ১৬ এপ্রিল রাতে মহারাষ্ট্রের কান্দিভালি থেকে গুজরাটের সুরাটে যাচ্ছিলেন কান্দিভালির একটি আশ্রমের দুই সাধু। একজনের বয়স ৭০, অন্য জনের ৩৫। একটি গাড়ি ভাড়া করে সুরাটে এক পরিচিতের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তাঁরা। মহারাষ্ট্র থেকে গুজরাটে যাওয়ার সব চেয়ে সহজ রাস্তা মুম্বই-আমদাবাদ হাইওয়ে। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেখানে একাধিক পুলিশ পোস্ট থাকায় ভিতরের রাস্তা দিয়ে পৌঁছনোর সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই মতো পালঘরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা।
আদিবাসী উপজাতি অধ্যুষিত পালঘরে গত কয়েক দিন ধরেই একটি গুজব হাওয়ায় ভাসছে। কেউ বা কারা রটিয়ে দিয়েছে, এলাকায় ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তারা পাচার করে দিচ্ছে এবং সুযোগ মতো দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। গুজবের কারণেই দিন দশেক ধরে এলাকায় রাত পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় মানুষরা। এর আগে পুলিশ এবং একদল চিকিৎসকের উপরেও চড়াও হয়েছিলেন তাঁরা। ওই চিকিৎসকরা লকডাউনের কারণে এলাকায় ওষুধ পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। ১৬ এপ্রিল রাতে ওই এলাকা দিয়ে যখন দুই সাধু যাচ্ছিলেন তখন তাঁদের উপরেও চড়াও হন এলাকাবাসী। শুরু হয় গণধোলাই। ছাড় দেওয়া হয়নি গাড়ির চালককেও। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে গণধোলাইয়ের সেই দৃশ্য ভাইরালও হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও আক্রান্তদের বাঁচানোর বিশেষ চেষ্টা করেনি। উন্মত্ত জনতার হাতে প্রবল মারখেয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তিনজনের। পুলিশের চোখের সামনেই।
আশ্চর্য বিষয় হলো, ঘটনা ঘটার পর পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, সাম্প্রদায়িক কারণেই হত্যা করা হয়েছে ওই দুই সাধুকে। বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী, পরিচিত বিজেপি সমর্থক এবং কোনও কোনও বিজেপি নেতা ওই ভিডিও ফেসবুক-টুইটারে শেয়ার করে লেখেন, 'মহম্মদ আকলাখকে মারা হলে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করে। কিন্তু দুই হিন্দু সাধু মুসলিমদের হাতে মার খেলে কেউ কোনও কথা বলেন না।' ভিডিও শেয়ার করে তাঁরা লিখেছেন, প্রহারকারীরা বার বার 'শোয়েব শোয়েব' বলে চিৎকার করছেন এবং সাধুদের মারার জন্য উৎসাহিত করছেন। কিন্তু ভিডিওগুলি খুব মন দিয়ে দেখলে এবং শুনলে বোঝা যাবে, সেখানে শোয়েব নামের কোনও উল্লেখ নেই। যা শোনা যাচ্ছে তা হল-- 'বাস, ওয়ে বাস।' অর্থাৎ, এ বার থামো।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্বব ঠাকরে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখও জানিয়ে দিয়েছেন যে, ওই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও সম্পর্ক নেই। যে আদিবাসী অঞ্চলে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে অধিকাংশই হিন্দু। কিছু কিছু এলাকা খ্রিস্টান। যে ১০১ জনকে গণপ্রহারের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদেরও অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ফলে এই মর্মান্তিক ঘটনার পিছনে সাম্প্রদায়িক উস্কানি যে নেই, তা স্পষ্ট। যাঁরা তা প্রচার করছেন, তাঁদের যে অন্য উদ্দেশ্য আছে, তাও পরিষ্কার।
ফেরা যাক ২০১৮ সালের পশ্চিমবঙ্গে। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ, রাজ্যের বিভিন্ন আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া এলাকায় একের পর এক গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটছিল। খবর সংগ্রহ করতে এলাকায় গিয়ে দেখেছিলাম, প্রত্যেক জায়গাতেই একই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এলাকায় ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিশুদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক পালঘরের মতোই। যে সমস্ত এলাকায় গুজব ছড়িয়েছিল, তার একটি জায়গাতেও কোনও শিশু হারিয়ে যায়নি। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি তো অনেক পরের বিষয়। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, ওই সমস্ত গুজব ছড়ানোর পিছনে একটি শক্তিশালী চক্র কাজ করছে। এলাকার বিশিষ্ট লোকেরা এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এই গুজব ছড়ানো এবং তাকে কেন্দ্র করে গণধোলাইয়ের পিছনে রাজনীতি কাজ করছে।
রাজনীতি যে কাজ করেছিল, কিছুদিনেই তা স্পষ্ট হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, ওই সমস্ত এলাকায় বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর আইটি সেল ভুয়ো ভিডিও ভাইরাল করেছিল। জাল ছবি ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাই ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিশুপাচার করছে। যার জেরে নদিয়া, মালদা, জলপাইগুড়িতে একের পর এক গণপ্রহারের ঘটনা ঘটতে থাকে। মৃত্যু হয় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের। বিহার থেকে আসা একদল সাধুর ওপরেও আক্রমণ হয়েছিল। প্রহারকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানতে পেরেছিলাম, তাঁরা ভেবেছিলেন, সাধুর ছদ্মবেশে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করছে আততায়ীরা। ঘটনার পিছনে যে এলাকার হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মদত ছিল, সে কথাও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিলেন ওই নেতারাই। যথারীতি ওই ঘটনার পরে ফেসবুক-টুইটারে প্রচার করা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক হামলায় লাঞ্ছিত হয়েছেন সাধুরা। কিছু দিন আগে রাজস্থানেও একই ঘটনা ঘটেছে। চিত্রনাট্যে কোনও বদল নেই। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয়, মহারাষ্ট্রের ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনও বিষয় নয়। এর পিছনেও ওই একই ধরনের চক্র কাজ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, যে সমস্ত রাজ্যে গেরুয়াবাহিনীর দাপট এখন কম, সেখানে মানুষের ভিতর এ ভাবে ত্রাস তৈরি করে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিতে চায় তারা। বেছে নেওয়া হয়, আদিবাসী বা পিছিয়ে পরা অঞ্চল। যেখানে গুজব ছড়ানো সহজ। পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং জলপাইগুড়িতে যে তাদের মদত ছিল, পরবর্তীকালে তা অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের ঘটনা পরম্পরাও সেই একই ইঙ্গিত দিচ্ছে।