গাছ বাঁচাতে হাতি তাড়াচ্ছে মৌমাছি!
১ আগস্ট ২০১৮দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে প্রাণিবিজ্ঞানী রবিন কুক ও রনি মাকুকুলে ৫০টি মৌচাক প্রস্তুত করেছেন৷ ক্রুগার ন্যাশানাল পার্কের ঠিক পাশেই মৌমাছিদের এই বসতি রাখা হয়েছে৷ মোমাছিরা পার্কের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু গাছ বাঁচাতে পারে কিনা, তা জানতে এক বছরের বেশি সময় ধরে এই দুই সংরক্ষণবাদী পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷
হাতি তাড়াতে মৌমাছি
অবিশ্বাস্য মনে হলেও এইমৌমাছিরা পার্কের সবচেয়ে বড় বাসিন্দা,অর্থাৎ হাতিদেরও তাড়িয়ে দিতে পারে৷ মানুষের মতো তারাও মৌমাছির হুল পছন্দ করে না৷ হাতিদের ঘ্রাণশক্তিও খুব তীব্র৷ তাই মৌচাকের গন্ধ পেলেই তারা দূরে সরে যায়৷ রবিন কুক বলেন, ‘‘আমরা এমনটা করছি, কারণ দক্ষিণ আফ্রিকায় সংরক্ষিত এলাকায় হাতিদের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গেছে৷ বড় প্রজাতির গাছের উপর তাদের প্রভাব নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়েছি৷ তাই গাছের উপর হাতিদের প্রভাব প্রশমিত করার উপায় খুঁজছি৷ সেই সব গাছে মৌচাক বসিয়ে হাতিদের দূরে রাখা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি৷''
আফ্রিকার অন্য সব অংশে হাতিদের সংখ্যা কমে এলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের সংখ্যা বাড়ছে৷ সেখানে সংরক্ষিত অরণ্য বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ আছে মানুষের তৈরি কুয়া৷ এমন সুরক্ষা ও খোরাক পেয়ে হাতিদের বংশবৃদ্ধি ঘটছে৷ কিন্তু তাদের সংখ্যা বাড়ার ফলে সমস্যাও দেখা দিচ্ছে৷ হাতি গাছপালা, ঝোপঝাড় সাফ করে দিচ্ছে৷ তাদের শিকড়ও প্রায়ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে পার্কের অন্যান্য প্রাণী ও গাছপালার আবাস ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷
বিপন্ন মারুলা
পার্কে মারুলা নামের বিশেষ এক প্রজাতির গাছের প্রতি হাতিদের নজর বেশি৷ রবিন কুক এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘হাতিদের কাছে মারুলা গাছের বিশাল চাহিদা রয়েছে, কারণ এই গাছ থেকে তারা অনেক খোরাক পায়৷ ফলে এই প্রজাতির গাছের উপর তাদের প্রভাব বাড়ছে৷ এই এলাকার গবেষণার ফল অনুযায়ী হাতিরা আসার পর থেকে এই গাছের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ কমে গেছে৷ তাই মারুলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি৷ এই গাছ খাদ্য হিসেবে, পশুপাখির আবাস হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করে৷''
অনেক সময় হাতিরা শুধু পাতার নাগাল পেতে গোটা গাছ মাড়িয়ে নষ্ট করে৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত মৌচাক থাকলে এমন গাছ সাধারণত অক্ষত রয়েছে৷ গত বছরে মোট ৫০টির মধ্যে একটির ক্ষতি হয়েছে৷
গাছ বাঁচাতে অভিনব প্রকল্প
‘কুকস বি প্রজেক্ট' পার্কের পরিচালকদের নতুন এক প্রচেষ্টা৷ অতীতে বড় সংখ্যায় হাতি সরিয়ে ফেলা হতো৷ পশুপাখির সংখ্যা ও খোরাকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে ক্রুগার ন্যাশানল পার্কে গুলি করে প্রায় ১৭,০০০ হাতি মারা হয়েছে৷ হাতি গবেষক তামারা এগেলিং বলেন, ‘‘বড় আকারে গাছের উপর হাতির প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হাতিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার মনোভাব এখন বদলে গেছে৷ অতীতে এভাবেই গাছপালার উপর হাতিদের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করা হতো৷ এবার বৃহত্তর পরিসরে বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে৷ বড় গাছগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সুরক্ষা দিলেই চলবে৷ এভাবে হাতিদের ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে৷''
বিজ্ঞানীরা মৌচাকের মাধ্যমে হাতিদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আশা করছেন৷ কারণ এভাবে হাতিরা চলমান অবস্থায় থাকবে৷ একই জায়গায় বেশিকাল থাকলে বড় আকারে ক্ষতি করতে পারে তারা৷
সংরক্ষণবাদীদের মতে, পাখির বাসায় ভরাগাছের মতো কোনো বিশেষ আগ্রহের বস্তু থেকে হাতিদের দূরে রাখতে মৌমাছিদের ব্যবহার করা আদর্শ পথ৷ রবিন কুক বলেন, ‘‘হাতিরা প্রায়ই গাছের বাকল ছাড়িয়ে নেয়৷ তার ফলে গাছের প্রতিরক্ষার ক্ষমতা কমে যায়৷ যেমন উইপোকা বাসা বাঁধতে পারে, আগুনে গাছের ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়৷ বাকল সরানোর ফলে গাছের ভিতরে পোকা খেয়ে নিয়ে ফাঁপা করে দেয়৷''
বৃহত্তর প্রভাব
মৌমাছিরা সম্ভবত হাতিদের দূরে রাখতে পারবে৷কিন্তু শকুনির মতো লুপ্তপ্রায় প্রজাতি মৌমাছির অস্তিত্বের ফলে কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়৷
পার্কের আশেপাশের গ্রামগুলির মানুষের মৌমাছি নিয়ে অভিজ্ঞতা কম৷ অনেকেই তাদের ভয় করে৷ রনি মাকুকুলে সেই মনোভাব বদলানোর চেষ্টা করছেন৷ তিনি নিজের গ্রামেই মৌচাক রেখে কিছু স্থানীয় মানুষকে মৌমাছি পালনের প্রশিক্ষণ দিতে চান৷
গ্রামের ঠিক বাইরে এক জমিতে প্রথম মৌচাকগুলি বসানো হবে৷ তিনি গ্রামবাসীদের ভয়ভীতি দূর করে তরুণ-তরুণীদের মৌমাছি পালনের কৌশল শেখাতে চান৷ মাকুকুলে বলেন, ‘‘মৌমাছি প্রকল্প শুরু করে আমরা সমাজের আয় বাড়ানোর কাজে সাহায্য করতে পারবো৷ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রকল্প শুরু করতে পারবে৷ সুপারমার্কেটে মধু বিক্রি করতে পারবে৷''
পার্কের ভিতরে সংরক্ষণবাদীরা অন্য একটি পদ্ধতিতেও সংকটপূর্ণ এলাকায় হাতিদের সংখ্যা কমাতে সফল হয়েছেন৷ তাঁরা বেশ কয়েকটি কুয়া শুকিয়ে ফেলেছেন৷ ফলে পানির খোঁজে হাতিদের সচল থাকতে হবে৷ তখন স্থানীয় ইকোসিস্টেমের উপর চাপ কমবে৷
কিন্তু ছোট আকারের পার্কের সেই সুযোগ নেই৷ তাই মৌমাছি নিয়ে রবিন কুক-এর পরীক্ষার বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে৷ তাঁর মতে, বৈপ্লবিক এই পদ্ধতির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে৷
স্টেফান ম্যাল/এসবি