স্বজনদের কান্না
৩১ আগস্ট ২০১৪শনিবার ঢাকায় এক সম্মেলনে বিশিষ্ট নাগরিক এবং আইনজীবীরা বলেছেন প্রয়োজনে গুম-অপহরণের বিচার চাইতে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া হবে৷
‘‘গত বছরের ৪ ডিসেম্বর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত তিনটি গাড়িতে করে ব়্যাব পরিচয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আমার ভাইসহ মোট সাতজনকে তুলে নিয়ে যায়৷ আমরা দেরি করিনি৷ আধ ঘণ্টার মধ্যে সবাই ব়্যাব-১ এ যাই,'' কথাগুলো বলছিলেন সানজিদা ইসলাম৷ নিখোঁজ সাতজনের একজন সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন তিনি৷
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সম্মেলনে সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘‘গত নয়মাস ধরে ওরা মিথ্যে বলছে৷ বলছে, ওরা কিছু জানে না৷ ওরা যদি তুলে নিয়ে না-ও যায়, ওরা খুঁজে দিক৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাইয়ের একটাই দোষ, বিএনপি করত৷ পারিবারিকভাবেই আমরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত৷''
এরকম আরো অনেক নিখোঁজের পরিবারের সদস্যরা শনিবার সমবেত হয়েছিলেন মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘‘স্বজনদের ব্যথা: গুম, খুন, নির্যাতন আর না'' শীর্ষক সম্মেলনে৷
আর সেখানে আরো অনেকের মত হাজির হয়েছিলেন লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের মেয়ে মাশরুফা ইসলাম৷ গত বছরের নভেম্বর থেকে সাইফুল ইসলাম নিখোঁজ৷ মাশরুফা অভিযোগ করেন, ব়্যাব পরিচয়ে তাঁর বাবাসহ তিনজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর একজনকে পাওয়া গেলেও তাঁর বাবাসহ দু'জনের আজও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷
তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘‘আমরা কেউই দেশে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারছি না৷ নিজের দেশেই নাগরিকেরা গুম হচ্ছেন, তাহলে কী লাভ হলো স্বাধীন হয়ে?''
মাশরুফা বলেন, ‘‘আমার বাবাকে কী করা হয়েছে, আমরা জানি না৷ তিনি জীবিত, না তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে তাও জানি না৷ এ ঘটনায় মামলা করা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই৷ তারপরও নানা রকমের চাপ রয়েছে মামলা না চালানোর জন্য৷''
সম্মেলনে গুম হওয়া ২০ জনের পরিবারের সদস্যরা মঞ্চে পর্যায়ক্রমে তাদের স্বজনদের গুম হওয়া, ফিরে না আসা এবং বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন৷ আর তাদের বর্ণনার সময় সবার চোখই অশ্রুসজল হয়ে ওঠে৷
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান মাঝে মাঝে আরো কিছু অপহরণ এবং গুমের বর্ণনা দেন৷ আর তাতে পরিবেশ আরো ভারি হয়ে ওঠে৷
সম্মেলনের বক্তা আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘ব়্যাব যদি থাকে, আর আপনারা যদি ক্ষমতায় না থাকেন, তাহলে এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আপনাদের ওপরই ঝাপিয়ে পড়বে৷ ২০০৬ সালে বলেছিলাম, খালেদা জিয়া, আপনাদের এই ব়্যাব দানব হবে৷ এখন খালেদা জিয়া সে বিষয়টি উপলব্ধি করছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি গুমের বিচার হতেই হবে৷ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না৷ এটা আমাদের দেশ৷ এই দেশে এভাবে মানুষকে ধরে নিয়ে যাবে, আর সবাই কান্নাকাটি করবে, এটা হবে না৷''
শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘আপনারা ক্ষমতায় এসে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন, এই বিচার এ দেশে না হলে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব৷''
সম্মেলনে প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘জনগণের জানমালের নিরাপত্তা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার৷ এ অধিকার আদায়ে আমাদের সব সময় সজাগ, সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে৷ খুন-গুমের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপোশ হতে পারে না৷''
সম্মেলনটি সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শুরু হয়ে বিকেলে শেষ হয়৷ এতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ ও গুম-খুন হওয়া শতাধিক ব্যক্তির স্বজনরা অংশ নেন৷ তারা প্রায় প্রত্যেকেই সম্মেলনস্থলে হাজির হন নিখোঁজ স্বজনের ছবি বুকে নিয়ে৷
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ২০০২ সালে কাজ শুরু করে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে৷ ২০১১ সাল থেকে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয় জাতিসংঘের উদ্যোগে৷