‘গেলমান’ বৈধ হলে, সমকামিতা নয় কেন?
২৮ অক্টোবর ২০১৫ধরুন, আপনি কোথাও বসে আছেন৷ দু'টি মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন৷ তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কটা বোঝার চেষ্টা করছেন৷ তাঁদের ভালোবাসার ব্যাপ্তি এখন আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন৷ তাঁদের মান-অভিমান, ভালো লাগা-মন্দ লাগা৷ আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, এ সব কিছুই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে আপনি বুঝতে পারছেন৷ সেই মানুষ দু'জনার মুখগুলো এখন আপনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, যা এতক্ষণ পারেননি৷ যে সম্পর্কটিকে আপনি বিভিন্ন ভালোলাগার উপমায় উপমিত করে এসেছেন, সেই সম্পর্কটিকেই পরক্ষণে আপনি ঘৃণা করতে লাগলেন, যখন দেখলেন ওই মানুষ দু'জন সম লিঙ্গের৷
আমি যে সমাজে বেড়ে উঠেছি, এই সমাজের অধিকাংশই সমকামিতাকে দেখে এক ঘৃণ্য রোগের মতো৷ এরা নারী-পুরুষ ব্যাতিত কোনো সম্পর্ককেই স্থান দিতে একবারেই দ্বিমত৷
বাংলাদেশে সমকামীদের সামাজিক অবস্থান খুবই শোচনীয়৷ এখানে পরিবেশগত ভাবে নারী-পুরুষ সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক ভাবতে পারে না৷ আর তাই সমকামিতাকে দেখা হয় ঘিন-ঘিনে কোনো বিষ্ঠার মতো৷ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সমকামিতাকে বৈধতা দিলেও, বর্তমানে বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে, বাংলাদেশে সমকামীদের স্বীকৃতি প্রদানের সম্ভাবনা সুদূর প্রসারী৷
আমার অনেক কাছের বন্ধু-বান্ধবীরাই সমকামী৷ কিন্তু তারা এই সম্পর্ককে রাখে অতি গোপনীয়তার সাথে৷ কারণ সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবার আশংকা তাদের ভীত করে রাখে৷ আর আমাদের সমাজে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মালম্বী এবং ইসলামে যেহেতু সমকামিতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাই ধর্মের অযুহাত এক্ষেত্রে শক্তিশালী৷ কারণ আমাদের সমাজে ধর্মকে হাতিয়ার বানানো খুবই সহজ এবং কার্যকর একটি প্রক্রিয়া৷
কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিলে সমকামীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হয়৷ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের ‘অভিশপ্ত কওমে লুতের প্রেতাত্মা' বলে অভিহিত করে হেফাজতে ইসলাম৷ তারা বলে, সম্প্রতি দেশে সমকামীদের প্রকাশ্য সংঘবদ্ধ উৎপাতকে আমরা এই সমাজের সুদীর্ঘ সামাজিক ঐতিহ্য ও জীবনাচার এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি তীব্র হুমকিস্বরূপ বলে মনে করি৷ অদূর ভবিষ্যতে সমকামীদের নিয়ে কোনো ধরনের প্রকাশ্য অবস্থান বা কর্মসূচি রুখে দিতে হেফাজতে ইসলাম এবং এ দেশের তৌহিদি জনতা বদ্ধপরিকর৷
অথচ প্রায়ই এমন খবর শোনা যায়, মাদ্রাসায় সমকামিতার ছড়াছড়ি, মাদ্রাসার ইমামের অংশগ্রহণও থাকে৷ আবার অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, ইসলাম ধর্মে যে বেহেস্তের উল্লেখ রয়েছে, যেখানে পুণ্যবান মানুষের স্থান হবে, সুখ-সমৃদ্ধে ভরপুর থাকবে, সেখানে ‘গেলমানের' (তরুণ পুরুষ, যারা হবে সুরিক্ষিত মনিমুক্তার মতো সুদর্শন) ব্যবস্থাও রেখেছে৷ তাহলে বেহেস্তে যদি সমকামিতাকে পুণ্যবানের পুরস্কার হিসেব রাখা হয়, সেই একই বিষয় পৃথিবীতে কোনো নিষিদ্ধ এবং ঘৃণ্য বস্তু রূপে দেখছে ধর্ম?
পরিবেশগতভাবে কোনো কিছুতে অভ্যস্ত নাই থাকতে পারি, এতে করে সে বিষয়টিকে গ্রহণ করতে একটু সময় লাগতেই পারে, সেটা অসম্ভব কিছু না৷ একসময় নারীদের বাইরে কাজ করা তো অসম্ভব চিন্তার একটা বিষয় ছিল৷ কিন্তু আজ নারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে না? এখন উন্নত বিশ্বগুলোতে সমকামিতাকে দেখা হয় খুবই স্বাভাবিক ভাবে, নারী-পুরুষের সম্পর্কের মতোই৷ অথচ আমরা সেই অন্ধকারেই পরে আছি৷ এখনো আমাদের আইনে আছে ৩৭৭ ধারা৷ যেখানে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী – যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সহিত প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে – যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে – দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে৷
অনেকেই মনে করে থাকে সমকামিতা, এগুলো পাশ্চাত্যে তৈরি৷ কিন্তু এটা একেবারেই সঠিক না৷ এটা সম্পুর্ণই প্রাকৃতিক ব্যপার৷ প্রাকৃতিকভাবে একজন মানুষ তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যেমন আকর্ষণ বোধ করে, তেমনি সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষম বোধও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক৷ কিন্তু এক্ষেত্রেও মৌলবাদী এবং রক্ষণশীল সমাজের হুমকি-ধামকি অহরহই ঘটছে৷
ধর্ম, পরিবেশ, সামাজিক বাস্তবতা এবং আইন – এই সকল বিষয়ের কারণে সমকামীরা তাঁদের সম্পর্কগুলোকে রাখতে হয় গোপনীয়তার সাথে৷ কিন্তু পরিবর্তন তো আসবে, আসতেই হবে৷ কিস্তু সেই পথটা নিশ্চয়ই দুর্গম হবে৷ সমকামীদের আওয়াজ তুলতে হবে, গোপনীয়তার বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে৷ কাউকে না কাউকে তো পথ তৈরি করতেই হবে আগামীর জন্য৷ ৩৭৭ ধারার অবসান ঘটাতে হবে৷ বাংলাদেশেও উড়বে রং ধনুর সাতরঙের পতাকা৷ যে পতাকার সাতটি রঙের শুভ্রতায় ঘুচে যাবে সকল অন্ধত্ব, সকল বাধা৷ সমকামীরা তাঁদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটাবে স্বাধীনভাবে৷ এমন দিনের প্রত্যাশায় আছি৷
সমকামিতাকে আপনি কিভাবে দেখেন? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷