গোপন রোগে বৈষম্যের শিকার পাকিস্তানি নারীরা
২২ জানুয়ারি ২০২২পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ছোট শহর ঘোটকির আলি মেহের গ্রামের বাসিন্দা রেহানা কাদির দাদ৷ ত্রিশ বছর বয়সি এই নারী চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের পছন্দের কোনো কাজ করতে৷ কিন্তু তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা নামে জটিল এক রোগে৷ তাতেই ভেস্তে যেতে শুরু করে তার স্বপ্ন৷
অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় প্রতি বছর আক্রান্ত হন এমন হাজারো নারী৷ এই রোগে দীর্ঘ সময়ের প্রসব যন্ত্রণায় যোনিপথ ও মূত্রাশয়ের মাঝে তৈরি হয় ক্ষত৷ পাকিস্তানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা এই রোগের যথাযথ চিকিৎসা পান না৷ বরং নানা রকমের কুসংস্কার ও হেনস্তার শিকার হন৷
উচ্চশিক্ষার আশা নিয়ে ২০১২ সালে বিয়ে করেছিলেন রেহানা৷ কিন্তু রাতারাতি তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় তার জন্য৷ প্রায়ই মারধর করতেন তার স্বামী৷ তারপরও পরিবারের সম্মানের কারণে সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন মুখ বুজে৷ কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরে তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সমস্যা আরো জটিল হয়ে পড়ে৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, প্রসবের সময় তার অস্ত্রোপচার বেশ জটিল ছিল৷ একজন নার্সের ভুলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়৷ এ সময় মারাত্মক যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তিনি৷ বারবার স্বামীকে বলছিলেন, তার নিশ্চয়ই কোনো সংক্রমণ হয়েছে৷ কিন্তু এ কথা শুনে স্বামী তাকে উলটো মারধর করেন৷ লাথি মারেন রেহানার পেটে৷ এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন রেহানা৷ তিনি জানতেন না অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা আসলে কী, কিন্তু তার গ্রামের অন্য নারীদেরও এমন সমস্যা ছিল৷
অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা নারীদের লজ্জা?
রেহানা বলেন, তিনি ফিস্টুলা আক্রান্ত হয়েছেন তা জানার পর সবাই তাকে অসম্মান করতে শুরু করেন৷ তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, হাসিঠাট্টা চলত সবসময়৷ কটাক্ষ করে লোকজন বলতেন, রেহানা মা হতে পারবেন না, তাই তিনি আর সম্পূর্ণ নারী নন৷ এই রোগে মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগ সংক্রান্ত সমস্যা হয়৷ আচমকা মূত্রত্যাগ করে ফেললে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাসাহাসি করতেন৷ একাধিকবার পরনের কাপড় কাচতে হতো তার বোনকে, ঘটনাচক্রে যিনি রেহানার নিজের জা৷
রেহানার বাবা তাকে চিকিৎসার জন্য সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ বাসচালকরা পর্যন্ত রেহানার শরীর খারাপ জেনে অপমান করেছিল৷ নীরবে চোখের জল সহ্য করে যান তিনি৷ করাচির কুহি গোথ নারী হাসপাতালে ২০২১ সালের মার্চে তার অস্ত্রোপচার হয়৷ তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন৷ তার মতো সমস্যায় যাতে অন্যরা না পড়েন সেজন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে চান তিনি৷
তিন সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানকে রেহানার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন তার স্বামী৷ মাসের পর মাস এই দুই সন্তানকে দেখেননি তিনি৷
এন্ডোস্কোপিক শল্য চিকিৎসক এবং নারী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ সানা আশফাক বলেন, রেহানার মতো একাধিক পাকিস্তানি নারী প্রতিনিয়ত এমন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে৷ অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা হওয়ার পর বেশিরভাগ নারীই তাদের পরিবার, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হন৷ বাসচালকরা পর্যন্ত বাস থেকে নামিয়ে দেন এই নারীদের৷ তাই রাস্তাঘাটে যাতায়াত করাও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে তাদের জন্যে৷
করাচির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক শাহিন জাফর ডয়চে ভেলেকে জানান, অনেকে এই রোগকে ঈশ্বরের অভিশাপ বলেন, কেউ বা বলেন দুষ্ট আত্মা ভর করেছে ওই নারীদের শরীরে৷ ভুক্তভোগী বেশিরভাগ নারী পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা৷ হাসপাতালে আসার সামান্য অর্থটুকুও তাদের নেই৷ দেশটিতে এই রোগের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেই পাকিস্তানি মুদ্রায় ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার রুপি খরচ হয়৷ জটিল অস্ত্রোপচারে খরচ আরো বেশি৷
গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্সরা অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত নন৷ এর ফলে প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়৷ এই রোগ নিয়ে গবেষণা চলছে বলেও জানান জাফর৷ প্রতি বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নারী অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন পাকিস্তানে৷ জাফর বলেন, ‘‘কুহিরে একটি মাত্র হাসপাতালে আমরা প্রতি মাসে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন নারীর চিকিৎসা করি, ২২ কোটির দেশে যা খুবই নগণ্য৷''
এস খান/আরকেসি