‘ফেরারি' জীবনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা
১৬ আগস্ট ২০১৮সরকারের এই অবস্থানের সমালোচনা করে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সমাজের আর কেউ যাতে কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ জানানোর সাহস না পায়, সেজন্য ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে সরকার৷
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য প্রচারে জড়িতদের সঙ্গে কোটা আন্দোলনের সংগঠকদেরও ধরা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন৷
তিনি বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এখন যারা কারাগারের বাইরে আছি, তারা সবাই পালিয়ে আছি৷''
দ্রুত কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে গত ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাংবাদিক সম্মেলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন হাসান ও তাঁর সহযোদ্ধারা৷
ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে পর্ষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূরকে বেদম মারধর করা হয়৷ পালিয়ে রক্ষা পান হাসান, তারপর থেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন তিনি৷
এরমধ্যে আন্দোলনের আরেক পরিচিত মুখ রাশেদ খানসহ অনেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷
হাসান আল মামুন বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের ১০ জন যুগ্ম আহ্বায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
‘‘এর বাইরে যারা আছে, তারা সবাই পলাতক৷ তারা বাড়িঘর বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলে থাকতে পারছে না। আমি নিজেও ঢাকা শহর ছেড়েছি। এখন নানাভাবে নানা জায়গায় থাকছি।''
ওই আন্দোলনের সংগঠক শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা৷
এরমধ্যে গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামেন ছাত্র-ছাত্রীরা৷ তাদের আন্দোলনে সমর্থন আসে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে৷
এর এক পর্যায়ে ৫ জুলাই ধানমন্ডিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ঘিরে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্র মৃত্যু ও ছাত্রীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণের মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়৷
এর সূত্র ধরে ফেইসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আলোকচিত্রী শহীদুল আলম ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ গ্রেপ্তার অভিযান এখনো অব্যাহত রেখেছে পুলিশ৷
কর্মকর্তারা বলছেন, সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যাচাই-বাছাই করে উসকানিদাতাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাঁরা৷
এদিকে ফেসবুকে উসকানিমূলক প্রপাগান্ডা ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে- এমন মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য, পোস্ট, ফটো বা ভিডিওতে লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট না করার অনুরোধ জানিয়েছে সিআইডি৷
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঘিরে বুধবার পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ জন এবং বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা সবাই কারাগারে আছেন।
এছাড়া বুধবার পর্যন্ত আন্দোলনে উসকানির অভিযোগে ৫১ মামলায় ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৬ জন।
বুধবার আহমেদ হোসাইন ও নাজমুস সাকিব নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয় গোয়েন্দা পুলিশ৷
আর ‘গুজব ছড়াবেন না' মর্মে মুচলেকা দেওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷ ইমি কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত ছিলেন৷
বুধবারই সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলা থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুমাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাকা থেকে যাওয়া পুলিশের একটি দল বেলকুচির চরাঞ্চল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। লুৎফুন্নাহার লুমা ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা রয়েছে৷
গ্রেপ্তার কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িতদের বিরুদ্ধে গত এপ্রিলে আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, ভাংচুর, মোটর সাইকেল পোড়ানো এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইন লংঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে৷
তবে এই গ্রেপ্তার অভিযানকে সরকারের আন্দোলন দমনের কৌশল মনে করছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা হাসান আল মামুন৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে চাইছে৷ তারা চায় কোটা সংস্কারের বিষয়টিকে একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দিতে আর এই সময়ে আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে, যাতে কোটা সংস্কার নিয়ে কোনো আন্দোলন আর হতে না পারে৷''
যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুমাকে যে মামলায় গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছে, ওই মামলায় তিনি আসামি ছিলেন না দাবি করে হাসান আল মামুন বলেন, ‘‘অন্যের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন ছাত্রলীগ তালিকা করছে। তারা যে তালিকা করে, সেই অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়৷''
কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭ জন শিক্ষক৷
বৃহস্পতিবার এক লিখিত বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের সন্তানতুল্য এই সব শিক্ষার্থীর প্রতি আইনের সঠিক প্রয়োগ চাই এবং অন্ততপক্ষে ঈদের আগে জামিনে তাদের মুক্তি চাই।
‘‘এসব শিক্ষার্থীর বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের হাহাকার আমরা প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে জানছি, পড়ছি এবং এগুলো আমাদের তীব্রভাবে ব্যথিত করছে৷ তাই আমরা অবিলম্বে আমাদের ছাত্রদের উপর এই অমানবিক নিপীড়নের সমাপ্তির জন্য সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আহ্বান জানাচ্ছি৷''
‘ভয়ের পরিবেশ'
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই অভিযানকে মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন মানবাধিকারকর্মী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান৷
তিনি বৃহস্পিতবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে আমার মনে হয়েছে, সরকার সমাজে একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতে চায়। আর সে কারণেই এ ধরনের গ্রেপ্তার , রিমান্ড অব্যাহত আছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন বলেন আর কিশোর ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন বলেন, সরকার তাদের দাবি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো। কিন্তু এখন যা সরকার করছে, তাতে মানুষকে সরকারের মুখোমুখি করে দিচ্ছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ আর যাতে কোনো অবস্থায়, কেনো পরিস্থিতিতে মাঠে নামতে না পারে, কোনো প্রতিবাদ করতে না পারে, ন্যায্য দাবি নিয়েও যাতে আন্দোলন করতে না পারে, সেরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে৷''
সরকারের এই অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের নেতা ফিরোজ আহমেদ৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ধারণা, সরকার দুটি কারণে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। প্রথমত, সরকার এক ধরনের আতঙ্কে ভুগছে৷ সেই আতঙ্ক থেকে নিজেকে বাঁচাতে এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চায়। জনসমর্থন না থাকার কারণে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
‘‘আরেকটি কারণ হলো, সরকার এখন ব্যাপকভাবে ষড়যন্ত্র বিকারে ভুগছে। যে কোনো ছোটখাট ঘটনায়ও ষড়যন্ত্র দেখছে। ফলে সরকার প্রয়োজনের চাইতে বেশি দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। এটা জনসমর্থনহীনতা থেকে হয়৷''