গ্রেপ্তারের আইনে পরিবর্তন আসছে?
২৪ মে ২০১৬ইসরাইলি রাজনীতিবিদের সঙ্গে বৈঠক করায় কয়েক দিন আগেই বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে সাদা পোশাকের পুলিশ৷ এক ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছে, কাউকে গ্রেপ্তারের সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পরিচয়-পত্র দেখাতে হবে৷
ভারতে গিয়ে ইসলাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নেতার সঙ্গে বৈঠক ও সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাতদিনের রিমান্ডে নেয়৷ তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, ‘‘আসলাম চৌধুরী যদি সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্র করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা দিয়ে রিমান্ডে নেয়া হোক৷ এখানে কেন ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার দেখাতে হবে?'' পরে অবশ্য পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অনুমতি নিয়েছে৷
শুধু ৫৪ ধারায় নয়, রাতের অন্ধকারে সাদা পোশাকে গিয়ে কাউকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসছে পুলিশ বা ব়্যাল৷ আটক হওয়া ব্যক্তির পরিবার জানছেন না যারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা পুলিশের লোক না কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য৷ কিছুদিন পর হয় ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে বা আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না৷ দীর্ঘদিনই ধরে বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি চলছে৷ ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের দমন করতে এই পন্থা বেছে নিয়েছে৷
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ মঙ্গলবার এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন৷ পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ৷
তবে হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনাগুলোতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে৷ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন৷ রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করা হলো, তবে হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনাগুলোতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে৷ পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে জানা যাবে৷
এই মামলায় বাদিপক্ষ বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)- এর আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই রায়টি ঐতিহাসিক৷ এই রায়ের ফলে জনগণের অধিকার নিশ্চিত হবে৷ পুলিশও তো সংবিধান মেনেই দায়িত্ব পালন করে৷ আমরাও চাই সবাই সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করুক৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও তো এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন৷ এই রায়ের ফলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে বলে আমি মনে করি৷''
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা৷ রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও এম আমীর-উল ইসলাম৷ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন৷
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, ডিটেনশন (আটকাদেশ) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না৷ কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ পরিচয়-পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে৷ গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে৷ ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাঁচঘেরা বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে৷ কক্ষের বাইরে তাঁর আইনজীবী বা নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন৷ জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে৷
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নীতিমালা প্রকাশের পর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সেখানে আমাদের আর বলার কিছু নেই৷ সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো৷ আদালতের নির্দেশনা এলে আমরা দেখব কোথায় আমাদের ঘাটতি হচ্ছে৷ সেটা দেখে আমরা ব্যবস্থা নেব৷''
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘‘৫৪ ধারার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘আইনে কিছু কিছু ইমার্জেন্সি প্রভিশন থাকে৷ ফৌজদারি কার্যবিধিতে যখন ৫৪ ধারা রাখা হয়েছে, তখন সেটা ইমার্জেন্সি প্রভিশন হিসাবেই রাখা হয়েছে৷ এটা ভালো নাকি মন্দ, সেটা ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে৷ এখন বাস্তবায়নের দিক থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় যদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেই জায়গায় যদি কোনো প্রভিশন (নির্দেশনা) হয়ে থাকে, সেটা ন্যায্য৷ কিন্তু সেকশন ৫৪ ধারাকে খারাপ বলা আমার পক্ষে কঠিন৷'' অপব্যবহার হয়েছে কিনা – এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘‘অতীতে 'সময়ে সময়ে' হয়ত এটা হয়েছে৷''
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করার পর ওই বছরেরই ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ-কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়৷ ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার৷ তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে৷ সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে৷ মঙ্গলবার সেটার চূড়ান্ত রায় হলো৷
আপনার মতে এই রায়ের ভালো দিক কোনগুলি? লিখুন নীচের ঘরে৷