‘গ্রেফতার এড়াতে’ ভারত থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা
১৯ মে ২০২২পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কয়েকজন জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশের ধরপাকড় শুরু হয়েছে৷ এসব অভিযানে দেশটিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ধরে নিয়ে জেল দেওয়া হয়েছে৷ পাশাপাশি সেখানে রোহিঙ্গারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷ সে কারণে তারা বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন৷ তাদের মতো অনেকে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
ভারত থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের চলে আসায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন৷ মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসছেন৷ ওই রোহিঙ্গারা ২০১২ সালে ভারতে গিয়েছিল এবং সে দেশের বিভিন্ন প্রদেশে ছিল৷ এখন তারা শুনেছে যে বাংলাদেশে এলে তারা খুব ভাল খাওয়া-দাওয়া পাবে৷ তাই রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে৷ আমরা ভারতকে বলবো যে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে৷''
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘সম্প্রতি ভারত থেকে আসা বেশ কিছু রোহিঙ্গা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ে যৌথ নিবন্ধন সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনুমতি চেয়ে ক্যাম্প ইনচার্জকে লিখিত আবেদন করেছেন৷ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি৷''
সরেজমিনে দেখা যায়, উখিয়ায় কুতুপালংয়ে ইউএনএইচসিআর পরিচালিত ট্রানজিট পয়েন্টের সামনে ভারত থেকে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের একটি দল কক্সবাজারে আশ্রয় পাওয়ার আশায় জড়ো হয়েছেন৷
এসময় ইউএনএইচসিআর থেকে পাওয়া কার্ড দেখিয়ে ভারত থেকে পালিয়ে আসা নুর আলম বলেন, ‘‘ভারতের জাম্বু থেকে কলকাতায় পৌঁছাই৷ সেখান থেকে বাংলাদেশের সিলেট হয়ে কক্সবাজারের এসেছি৷ জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দালালদের দিয়ে পাঁচদিনে এখানে পৌঁছেছি৷
তিনি বলেন, ‘‘ভারতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে জেলে দিচ্ছে৷ সেখানে ভালো করে থাকছে দিচ্ছে না৷ আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে৷ সেই কারণে এখানে পালিয়ে এসেছি৷ গত তিন দিন ধরে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরছি৷ কিন্তু কোথাও আশ্রয় পাচ্ছি না৷''
আলম বলেন, ‘‘ক্যাম্প থেকে এই ট্রানজিট পয়েন্ট পাঠিয়েছে৷ কিন্তু তারা আমাদের ঢোকাচ্ছে না৷ আমি ভারতে দিন মজুরি করে জীবনযাপন করছিলাম৷'' তার সঙ্গে আরো ত্রিশ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে জানান তিনি৷ এর আগে ২০১২ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন৷ পরে পরিবার নিয়ে দালালের মাধ্যমে ভারতে পাড়ি জমান নুর আলম৷
পরিবারের চারজন সদস্য ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভারত থেকে কুমিল্লা সীমান্ত হয়ে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে পৌঁছেছেন ছেনোয়ারা বেগম৷ তিনি বলেন, ‘‘দালালের খপ্পরে পরে আমাদের দ্বিগুন টাকা খরচ হয়েছে৷ মূলত সেদেশে গ্রেফতারের ভয়ে এখানে পালিয়ে আসি৷ আসার পথে দালালরা টাকা দাবি করে আটকে রাখে৷ পরে ৩০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে ছাড়া পাই৷ ফলে আমাদের এখানে পৌঁছাতে ৮ দিন কেটে যায়৷''
ছেনোয়ারা বলেন, ‘‘গত তিন দিন ধরে ক্যাম্পে ও রাস্তার আশপাশে দিন কাটাচ্ছি৷ এখনো কোথাও আশ্রয় পাইনি৷ ভারত থেকে পালিয়ে আসা অনেকে উখিয়ার ট্রানজিট পয়েন্টে আশ্রয় নিয়েছেন৷ তাই আমরা এখানে ঘুরছি৷ কিন্তু এখন কোনো সাড়া পাইনি৷''
রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে তারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসে কলকাতায় জড়ো হচ্ছেন৷ এরপর সেখান থেকে দালালদের মাধ্যমে সীমান্তের সিলেট, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন৷ এরপর টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি দালালেরা রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে পৌঁছে দেয়৷ অনেকক্ষেত্রে প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন তারা৷
এপিবিএন পুলিশের ভাষ্যমতে, গত দেড়মাসে ভারত থেকে পালিয়ে উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৮০০ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন৷ এর মধ্যে ছয়শো জনকে ক্যাম্পে একটি সেন্টারে কোয়ারান্টিনে রাখা হয়েছে৷ এছাড়া ট্রানজিট পয়েন্টে প্রায় দুশো রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন৷
ভারত থেকে সাতদিনে কক্সবাজার কুতুপালং শিবিরে পৌঁছেছেন ইব্রাহীম খলিল৷ তিনি বলেন, ‘‘ইন্ডিয়ার জাম্বুতে বসবাস করছিলাম৷ সেখানকার সরকার মুসলিমদের হয়রানি করছে৷ আমাদের চার থেকে পাঁচশো রোহিঙ্গাকে জেলে দিয়েছে৷ এখানে সেখানে নিরীহ মানুষ, এমনকি ছোট ছোট সন্তানদের রেখে পিতামাতাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে৷ আবার পিতামাতা রেখে সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছে৷ কোনো কথা ছাড়া জুলুম করছে৷ আমরা এখানে পালিয়ে আসছি৷ ৪০-৫০ হাজার টাকা ছিল, সেগুলো খরচ হয়ে গেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘কিছু টাকা দালালরা প্রতারণা করে নিয়ে গেছে৷ ভারতে দিনমজুরি করে সংসার চলছিল৷ সেখানে অন্য শরণার্থীও রয়েছে তাদের কিছু করছে না৷ শুধু রোহিঙ্গা মুসলিমদের অত্যাচার করছে সরকার৷''
ভারত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের খবর নিশ্চিত করে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, ‘‘এই ব্যাপারে পরে কথা বলবো৷''
তবে ৮-আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘ভারতসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসাদের প্রথমে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়৷ কোয়ারান্টিন শেষে আবার উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে সেখানকার প্রক্রিয়া শেষে ক্যাম্পে পাঠানো হয়৷ তার অধীনে এ পর্যন্ত ১২৪ জন রোহিঙ্গাকে এই প্রক্রিয়ায় ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে৷''
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচসিআর) বার্তা পাঠিয়ে এই বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি৷