ঘুস দিয়ে নিযুক্ত শিক্ষকেরা পড়িয়ে যাবেন ছাত্রদের?
৬ অক্টোবর ২০২২পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে নিয়োগ ঘিরে বিপুল দুর্নীতি সামনে এসেছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল টাকা। এই টাকার সঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতিকে জুড়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ, অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার পরিবর্তে টাকা নেওয়া হয়েছে। এই বিতর্কিত নিয়োগ নিয়ে একাধিক মামলা চলছে আদালতে। যদিও স্কুল সার্ভিস কমিশন আদালতে আর্জিতে বলেছে, যাদের নিয়োগ ঘিরে অভিযোগ রয়েছে, তাদেরও চাকরিতে বহাল রাখা হোক। কমিশনের এই সুপারিশ ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বিতর্কিত নিয়োগেও বহাল?
সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু কমিশনের আর্জির কথা সাংবাদিক বৈঠকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী চান না কারো চাকরি চলে যাক। কারো চাকরি গেলে পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। যারা যোগ্য প্রার্থী তাদেরও বঞ্চিত করতে চান না মুখ্যমন্ত্রী।” কমিশনের দেওয়া অনিয়মের খতিয়ান তুলে ধরে ব্রাত্য বলেন, "নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশের অশিক্ষক কর্মচারী অর্থাৎ গ্রুপ ‘সি' ও ‘ডি'-র ক্ষেত্রে ৯৫৭ জনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ধরা পড়েছে। একই স্তরে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে ২২২ জনের ক্ষেত্রে।” এই ‘নিয়মের ব্যতিক্রম' সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্মী ও শিক্ষকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত না করার কথাই ভাবছে রাজ্য সরকার।
বিপুল অনিয়মের ছবি
যদিও আদালতে সিবিআইয়ের পেশ করা তথ্যে আরো বড়সড় অনিয়মের ছবি সামনে আসছে। কমিশনের ডেটা সেন্টার থেকে হার্ড ডিস্ক বাজেয়াপ্ত করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তার ফরেন্সিক রিপোর্ট আদালতে পেশ করা হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রুপ ‘সি'-তে তিন হাজার ৪৮১ জন, গ্রুপ ‘ডি'-তে দুই হাজার ৮২৩ জনের নম্বর বদল করা হয়েছে। একাদশ– দ্বাদশে শিক্ষক নিয়োগে ৯০৭ জনের নম্বর বদল করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৬৩১ জনের নাম প্যানেলে রয়েছে। নবম– দশমে নম্বর বদলানো হয়েছে ৯৫১ জনের। বিতর্কিত প্রার্থীদের উত্তরপত্রের যে কপি সিবিআইয়ের হাতে এসেছে, তার উল্লেখ করে সংস্থাটি চাঞ্চল্যকর দাবি করেছে। যে প্রার্থীর উত্তরপত্র সাদা, কমিশনের ডেটাবেসে তার প্রাপ্ত নম্বর ৫৩!
শিক্ষা ঘিরে প্রশ্ন
বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরিতে বহাল রাখার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবকে খারিজ করে দিয়েছে বিরোধীরা। তাদের দাবি, যারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে, তাদের সবাইকে বরখাস্ত করতে হবে। শিক্ষা মহলের একটা বড় অংশ এই দাবির সঙ্গে সহমত। অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটি-র সম্পাদক, সাবেক বিধায়ক তরুণ নস্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেউ নিয়ম ভেঙে চাকরিতে ঢুকে যাবে আর তার চাকরি থাকবে, এটা আইনগত বা নৈতিকভাবে সিদ্ধ নয়। শিক্ষা ব্যবস্থা অযোগ্য শিক্ষকে ভরে যাবে। এই শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের নীতির শিক্ষা দিতে পারবেন না। এটা সমাজের নৈতিকতার মানকেও তছনছ করে দেবে।”
অযোগ্যদের চাকরি যাবে?
সিবিআইয়ের পেশ করা ফরেন্সিক রিপোর্ট দেখে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। বলেছেন, "বেআইনিভাবে চাকরি পাওয়া সমস্ত প্রার্থীরা চাকরি হারাবেন। তারা যদি নিজে থেকে পদত্যাগ করেন তো ভাল। নইলে আদালত তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে। এই প্রার্থীরা যাতে আর কোনো দিন সরকারি চাকরি না পান, তার ব্যবস্থা করা হবে।” এই মতকে সমর্থন জানিয়ে অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর সভাপতি ড. হরিদাস ঘটক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অযোগ্যদের চাকরি চলে যাওয়া উচিত। একটা দৃষ্টান্ত তৈরি না হলে ভুল বার্তা যাবে। যিনি অযোগ্য তিনি স্কুলে পড়াবেনই বা কীভাবে?”
বঞ্চিত পড়ুয়ারা
শিক্ষার অধিকার এখন আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত। ২০০৯-এর শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রকে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতির জেরে নিয়োগে ধীরগতি, স্কুলে
শিক্ষকের অভাবের জেরে প্রাথমিকের পড়ুয়ারা বঞ্চিত হচ্ছে মাসের পর মাস। ইউনাইটেড গার্ডিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন-এর আহ্বায়ক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকার ভয় পাচ্ছে। এত অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছে যে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করলে রাজ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে। সেটা এই সরকারের বিরুদ্ধেই যাবে।” বিত্তবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা টিউশন নিয়ে ক্ষতি কিছুটা পোষাতে পারলেও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কী হবে? এই সময়টা কি তাদের আর ফিরিয়ে দিতে পারবে রাষ্ট্র?