‘চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা'
১৬ মে ২০১২‘‘আমাদের বাড়ি থেকেই পালং থানায় অভিযান চালানো হয়৷ আমরা দেখলাম, পালং থানা দখল করতে না পারলে শরীয়তপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাফেরা ও কর্মকাণ্ড খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে৷ কারণ পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন মাদারীপুরে থাকতো, তখন স্পিড বোটে করে তাদের শরীয়তপুর আসতে মাত্র ১০/১৫ মিনিট লাগতো৷ এছাড়া পালং থানায় পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ছিলই৷ এ অবস্থায় আমরা পরিকল্পনা করলাম স্টুয়ার্ড মুজিবের নেতৃত্বে পালং থানা দখল করার৷ তখন আমাদের বড় বড় চারটা ঘর ভর্তি অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ছিল৷ আরো কিছু সামনের সারির মুক্তিযোদ্ধা এসে হাজির হলেন৷ আমি মেয়েদের নিয়ে বৈঠক করলাম৷ পালং থানা অভিযানে আমি, আমার বোন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের কয়েকজন অংশ নিলাম৷ তখন অনেক বর্ষা৷ নৌকায় করে আমাদের সেই অভিযানে যেতে হয়েছিল৷ আমরা পরিকল্পনা মাফিক সফলভাবে পালং থানা অভিযান চালিয়েছিলাম৷ আমাদের দখলে চলে আসে পালং থানা৷ কিন্তু এরপরই আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি থাকার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল৷ একদিন পাক সেনারা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে আসে৷ তারা লঞ্চে করে আমাদের বাড়ির বেশ কাছেই চলে এসেছিল৷ কিন্তু পথে একটি খাল কাটা ছিল৷ ফলে সেখান দিয়ে সৈন্যরা আসতে দেরি হয়েছিল৷ আর এসময় একটি ছোট্ট ছেলে চিৎকার দিয়ে জানিয়ে দেয় সৈন্যদের আসার খবর৷ ফলে সেদিন আমরা দ্রুত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাই৷'' এভাবেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নিজেদের অভিযানের কথা বলছিলেন বীর সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা খালেদা খানম৷
ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নানা ঘটনা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি উঠে যাওয়ার পর দোমসার, দাসাত্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি করা হয়৷ কিন্তু একটি জায়গায় খুব বেশি দিন ঘাঁটি রাখা যেতো না৷ আমি প্রায়ই নৌকাতে অস্ত্র বোঝাই করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতাম৷ মুক্তিযোদ্ধাদের বলতাম, আপনারা অস্ত্র বহন না করে খালি হাতে চলে যান৷ আমি আপনাদের জায়গামতো অস্ত্র পৌঁছে দেবো৷ তা নাহলে যোদ্ধারা পথে ধরা পড়ে যেতেন৷ কিন্তু আমি যখন নৌকায় করে অস্ত্র নিয়ে যেতাম, তখনও রাজাকার এবং পাক সৈন্যরা আমাকে নৌকা নিয়ে ঘাটে ডাকতো৷ আমি তাদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য মাঝেমাঝে আমার চাচাতো বোনকে নতুন বউ সাজিয়ে নৌকায় নিয়ে যেতাম৷ একদিন পাক সেনারা আমাকে ডাক দেয়৷ কিন্তু আমি জানি, ধরা পড়লে নৌকাভর্তি অস্ত্র তাদের হাতে চলে যাবে৷ আবার আমি সব মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা জানি - সেগুলো ওরা পেয়ে যেতে পারে৷ ফলে একবার অস্ত্র পানিতে ফেলে দেওয়ার কথা ভাবি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন অলৌকিকভাবেই বেঁচে যাই৷ আমাদের মাঝি বেশ চালাক ছিল৷ সে পাক সেনাদের একটি বাড়ি দেখিয়ে বলল, ঐ বাড়িতে যাচ্ছি৷ এরপর আমাদের ওরা ছেড়ে দিয়েছিল৷''
খালেদা খানম এবং তাঁর সহকর্মীরা বিশ্বাস করতেন যে, দেশ স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে৷ তাই খালেদা গুরুত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করতেন৷ এছাড়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে উঠান বৈঠক করার সময় তিনি সঙ্গে কাগজ আর কলম রাখতেন৷ যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী নারীদের নাম-ঠিকানা লিখে নিতেন৷ পরে তাদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ দিতেন৷ মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে খালেদা খানম বলেন, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের নারীরা যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এতোটা সাহায্য না করতো তাহলে এতো কম সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়া সম্ভব ছিল না৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শরীয়তপুর থেকে চট্টগ্রাম ফিরে যান সংগ্রামী নারী খালেদা খানম৷ আবারও লেখাপড়া শুরু করেন এবং পাশাপাশি দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন৷ তিনি চট্টগ্রাম জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন৷ খালেদা খানম সেই স্কুল জীবন থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এতোটাই সক্রিয় এবং সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন যে, সেখানকার মানুষ তাঁকে ‘চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা' বলে ডাকতো৷ পরে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঢাকায় গিয়ে তিনি কেন্দ্রে দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ এছাড়া প্রচার সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি৷
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন এই সাহসী নারী নেত্রী৷ এছাড়া লালমাটিয়া কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন এবং বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনি৷ ২০০৯ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন৷ তবে পেশাগত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেও দেশ গড়ার কাজে এখনও সামনের সারিতে রয়েছেন৷ বর্তমানে মহিলা আওয়ামী লীগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের নারী সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বীর নারী খালেদা খানম৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ