চট্টগ্রামের কিছু ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ইতিহাস বেশ পুরনো৷ ‘প্রাচ্যের রাণি’ হিসেবে পরিচিত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এ শহরে রয়েছে বহু প্রাচীন স্থাপনা এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন৷
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র
এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত৷ কালুরঘাটে অবস্থিত এই বেতারকেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়৷
টাইগারপাস
চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার অন্তর্গত টাইগারপাস সড়কটি পাহাড় এবং অসংখ্য গাছবেষ্টিত একটি চিরহরিৎ এলাকা৷ বেশ কয়েকটি সড়ককে সংযুক্তকারী এ সড়কের দু’টি মোড়ে রয়েছে দু’টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ভাস্কর্য৷ কথিত আছে, বহু আগে এই এলাকা দিয়ে দিনে-দুপুরে বাঘ চলাফেরা করতো এবং নিয়মিতভাবে বাঘের গর্জন শোনা যেতো৷
ইউরোপিয়ান ক্লাব
চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের বিনোদন-কেন্দ্র, যার দেয়ালে টাঙানো ছিল কুকুর এবং স্থানীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মতো বর্ণবাদী ঘোষণা, ‘‘Dog and Indian prohibited’’৷ ১৯৩২ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে এই ক্লাব আক্রমণ করা হয়৷ পরবর্তীতে প্রীতিলতার আত্মাহুতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ক্লাবটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে৷ জাদুঘরের পাশেই রয়েছে প্রীতিলতার ভাস্কর্য৷
চন্দনপুরা তাজ মসজিদ
১৫০ বছরের পুরনো চন্দনপুরা তাজ মসজিদ প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত৷ ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন-সুরকির দেয়ালে টিনের ছাদ দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন আবদুল হামিদ মাস্টার৷ মসজিদের চারদিকে যেন রঙের মেলা৷ লতা-পাতার নকশা ও নানান কারুকাজে মোঘল স্থাপনার আদলে তৈরি মসজিদটির সৌন্দর্য অনেক দূর থেকেও দেখা যায়৷
কালুরঘাট ব্রিজ
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত ৭০০ গজ দীর্ঘ কালুরঘাট ব্রিজ উদ্বোধন করা হয় ১৯৩০ সালে৷ প্রথমদিকে শুধু রেল চলাচলের কথা থাকলেও পরে এটিকে অন্যান্য যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা হয়৷ বর্তমানে এই সেতুর পাশেই তৈরি হচ্ছে নতুন রেল-কাম-সড়ক সেতু৷
অলি খাঁ মসজিদ
মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন এই মসজিদটি নবাব ওয়ালি বেগ খান ১৭১৩ থেকে ১৭১৬ সালের মধ্যে নির্মাণ করেন৷ এর গম্বুজের সংখ্যা ছ’ টি৷ অনিন্দ্য সুন্দর এই মসজিদটের দেয়ালগুলো প্রায় ১২ থেকে ৩৬ ইঞ্চি পর্যন্ত পুরু৷ এই স্থাপনাটিকে কয়েক বছর আগে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷
পর্তুগিজ ফোর্ট
পর্তুগিজ দূর্গ চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের উপনিবেশের স্বাক্ষর বহন করে৷ ১৫২৮ সালে পর্তুগিজরা প্রথম ব্যবসার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে তাঁদের ঘাঁটি স্থাপন করে৷ বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ভিতরে পাহাড়ের উপর পর্তুগিজ ফোর্টটির দেখা মিললেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুধু দালানটি ই কোনোমতে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে৷
পি কে সেন ভবন
ফিরিঙ্গি বাজারে অবস্থিত সাততলা পি কে সেন ভবনই ব্যক্তিপর্যায়ে নির্মিত চট্টগ্রামের প্রথম দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা৷ কলকাতা থেকে সুদক্ষ কারিগর এনে উনিশ শতকের শেষের দিকে ভবনটি তৈরি করেন প্রসন্ন কুমার সেন৷ লোকমুখে প্রচলিত আছে, একসময় মানুষ কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড় থেকে সদরঘাটের পি কে সেনের চূড়া দেখে বুঝে নিতো চট্টগ্রাম শহর চলে এসেছে৷
ফিশারি ঘাট
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক এবং মিঠা পানির মাছের পাইকারি বাজার ‘ফিশারি ঘাট’৷ প্রায় ২০০ বছর আগে ফিরিঙ্গি বাজারে এই ঘাটের গোড়াপত্তন করে পর্তুগিজরা৷ দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখান থেকে এ ঘাটে মাছ আসে না এবং যেখানে এ ঘাটের মাছ যায় না৷ মৌসুমভেদে দৈনিক পাঁচ থেকে ৫০ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় এখানে৷
পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন
‘বটতলি রেলওয়ে স্টেশন’ নামে পরিচিত দুই তলা বিশিষ্ট এই স্থাপনাটি ইংরেজ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এর নীচতলা ব্যবসায়িক স্থান ও উপর তলা কর্মকর্তাদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের জন্য নির্ধারিত হলেও ২০১৩ সাল থেকে রেলপথ সংস্কারের কারণে এটি বন্ধ আছে৷ স্টেশনটি বাংলাদেশের স্থাপত্য সংরক্ষণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে৷
ওয়ার সিমেট্রি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের সমাধিস্থল ওয়ার সিমেট্রি চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন স্পট৷ বিশ্বযুদ্ধে ইন্দো-বার্মা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণে মিত্রবাহিনীর যেসব সৈনিক প্রাণ হারান, তাদের সমাহিত করা হয় প্রাকৃতিক এই পরিবেশে৷ প্রায় সাত একর জায়গায় গড়ে ওঠা এই সমাধিস্থলে ৭৫৫জন সৈনিকের সমাধি রয়েছে৷ সমাধিস্থলটি দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক ভিড় করে থাকেন৷