চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের গ্রামে আতঙ্ক
১৩ নভেম্বর ২০২০নীলগিরি সংলগ্ন কাপ্রুপাড়ায় তৈরি হচ্ছে সিকদার গ্রুপের পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্র৷ জেলা পরিষদের কাছ থেকে ২০ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে তারা৷ সেনা কল্যাণ ট্রাস্টের সাথে তারা কাজ করছে যৌথভাবে৷ কিন্তু ম্রো জনগোষ্ঠীর আশঙ্কা ওই হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্রের কারণে এক হাজার একর জমি বেহাত হয়ে যাবে৷ উচ্ছেদ হবে পাঁচ গ্রামের মানুষ৷ আর সেই পাঁচ গ্রামে ১১৬টি পরিবার বসবাস করে৷ বান্দরবান শহর থেকে ৪৫ কি.মি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চিম্বুক-থানচি সড়কের পাশে এর অবস্থান৷
ওই এলাকারই বাসিন্দা রেং ইয়াং ম্রো বলেন, ‘‘তারা বলছেন ২০ একর জায়গায় হোটেল করবে৷ কিন্তু এরইমধ্যে আরো বেশি জায়গা জুড়ে তারা ঘিরে ফেলেছে৷ পাহাড় কাটা শুরু করেছে৷ ফলের বাগান নষ্ট হয়ে যাবে৷ পাহাড়ি ঝর্না বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ তারা পর্যটন কেন্দ্র করবে৷ ক্যাবল কার দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ঘোরার ব্যবস্থা করবে৷ আমাদের আশঙ্কা এক হাজার একরের মতো জমি তাদের দখলে চলে যাবে৷ সরাসরি পাঁচটি গ্রাম ও তার বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ আর এর প্রভাবে আরো ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷''
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ‘আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস' জানায়, চিম্বুকে ম্যারিয়ট হোটেল অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্কে পাঁচতারা হোটেল ছাড়াও ১২টি আলাদা ভিলা থাকবে৷ পর্যটকরা যাতে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে পারেন সেজন্য থাকবে ক্যাবল কার৷ থাকবে নানা ধরনের বিনোদন, রাইড এবং সুইমিং পুল৷ পুরোদমে কাজ চলছে৷ ২০২১ সালেই হোটেলটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হবে৷
জানানো হয় সেনাকল্যাণ ট্রাস্টের সঙ্গে তাদের এনিয়ে ৩৫ বছরের চুক্তি হয়েছে৷ যৌথভাবে তারা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে৷ আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস সিকদার গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন৷ এর চেয়ারম্যান রিক হক৷
গত ৮ নভেম্বর ম্রো জনগোষ্ঠী ওই এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে৷ তার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে৷
ইয়াঙান ম্রো একজন লেখক ও গবেষক৷ তিনি থাকেন চিম্বুক পাহাড় এলাকায়৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা দুই তিন মাস আগেই সাইনবোর্ড লাগিয়েছে৷ এখন পাহাড় কাটা শুরু করেছে৷ জেলা পরিষদের কাছ থেকে তারা ২০ একর জমি বন্দোবস্ত নিলেও এখন তারা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে এক হাজার একর জমি তাদের দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারা দূরে দূরে তাদের পিলার পুঁতেছে৷ তারা গ্রামের মধ্য দিয়ে রাস্তা বানিয়েছে৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়েছে৷''
ইয়াঙান ম্রো বলেন, ‘‘আমরা এখন অপেক্ষা করছি সরকার কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার জন্য৷ নয়তো আমাদের আরো আন্দোলন করতে হবে৷ কারণ এটা তো আমাদের বাঁচা-মরা৷''
ওই এলাকার মানুষ জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল৷ তারা নানা ধরনের ফলের বাগান করে টিকে আছেন৷ ওই এলাকা বেহাত হয়ে গেলে তাদের চাষের জন্য কোনো জমি থাকবেনা৷ তাই তারা অনেক শঙ্কার মধ্যে আছেন৷ কারবারী ঙানওয়াই ম্রো বলেন, ‘‘আমাদের আম বাগান, পেপে বাগানের ক্ষতি হবে৷ আমরা জুম চাষ করতে না পারলে বাঁচব কীভাবে? আমাদের জীবন এখানেই৷ তারা তো বিভিন্ন জায়গায় পিলার দিয়েছে৷ তার মধ্যে আমাদের যেতে দেয়না৷ প্রায় এক হাজার একর তারা নিতে চায়৷ তারা উন্নয়ন রাস্তার ঢালে করুক৷ কিন্তু তারপর আর না৷''
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবান জেলা পরিষদের কাছ থেকে সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ২০ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে৷ তাদের কাছ থেকে নিয়েছে সিকদার গ্রুপের আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস৷ তবে বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্ল মারমা জানান, ‘‘জেলা পরিষদের কাছ থেকে তারা ২০ একর জমি বন্দোবস্ত নেয়ার এমওইউ করেছে৷ এখনো হস্তান্তর হয়নি৷ কারণ এখন সাধারণভাবে জমি হস্তান্তর বন্ধ আছে৷ সরকার আমাদের বিশেষভাবে ওই জমি দিলে আমরা তাদের হস্তান্তর করব৷''
তাহলে সেখানে এখনই কীভাবে স্থাপনা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সেটা আমার জানা নাই৷ ২০ একর জমি রাস্তার পাশে ছোট একটি পাহাড়সহ এর বাইরে যে কয়েকশ' একর জমি দখলে নেয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে তা সম্ভব নয়৷ কেউ করতে চাইলেও আমরা সেটা হতে দেবনা৷ আমি এর বিরুদ্ধে৷''
সিকদার গ্রুপ এখন ২০ একরের সঙ্গে আরো ১০ একর জমি দাবি করছে৷ গ্রুপের সমন্বয়কারী ফরিদ উদ্দিন আহমদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি৷ গ্রুপের পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি৷ তবে কয়েকদিন আগে তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ‘‘কাগজে প্রথমে ২০ একরের কথা লেখা ছিল৷ পরবর্তীতে কয়েক বছরের মধ্যে পাহাড় ভেঙে যায়৷ এরপর আরও ১০ একর নেওয়া হয়৷ হোটেলের জন্য মোট ৩০ একরের বাইরে আর কোনো জমি নেই৷''
ফরিদ উদ্দিন আহমদ খান দাবি করেন, ‘‘স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এধরনের কথা ছড়াচ্ছে৷ হোটেল নির্মাণ হলে স্থানীয়দের জীবনমান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে৷''
হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্রে সেনা কল্যাণ ট্রাস্টেরও অংশীদারিত্ব আছে৷ বান্দরবান সেনা রিজিয়নের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার মো. শাহিনুর এমরান জানান, যেখানে সেনাবাহিনী এই কাজের সাথে জড়িত সেখানে কোনো অনিয়ম হবে না৷ হতে দেয়া হবেনা৷ ২০ একরের মধ্যেই হোটেল ও স্থাপনা হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘কাগজে কলমে ২০ একর জায়গা নেয়া হয়েছে৷ সিকদার গ্রুপ কোনো জমি দখল করে নাই৷ আমরা বলেছি খবরদার, যদি সম্ভব হয় আরো ১০ একর নেবেন৷ তা না হলে যেখানে আছেন তারমধ্যেই করতে হবে৷''
তিনি জানান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ম্রোদের সাথে দ্রুতই বৈঠক করবেন৷ আর তাদের উন্নয়নের জন্যও কিছু কাজ করা হবে৷ এখনই তাদের কিছু দোকান করে দেয়া হবে রাস্তার পাশে৷ তাদের প্রয়োজন হলে কিছু বাড়িঘরও করে দেয়া হবে৷