চিলির ‘নাইন ইলেভেন’-এর ৫০ বছর
সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে প্রতি বছর ভয়াবহ টুইনটাওয়ার হামলাকে স্মরণ করে সারা বিশ্ব৷ তবে চিলির ইতিহাসে দিনটি আগে থেকেই ‘কুখ্যাত’৷ ১৯৭৩ সালের এই দিনেই সালভাদোর আলেন্দেকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেনা স্বৈরশাসক আগুস্তো পিনোশে৷
সালভাদোর আলেন্দে : আত্মহত্যা, নাকি হত্যা?
মাত্র তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন চিলির প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দে৷ ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায় নেমে আসে অসংখ্য ট্যাংক৷ আকাশে উড়তে শুরু করে হক হান্টার বিমান৷ রাষ্ট্রপতির ভবনকে ঘিরে শুরু হয় বোমাবর্ষণ৷ এক সময় জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট আলেন্দে গৃহবন্দি৷ তারপর আসে সেনাপ্রধান অগুস্তো পিনোশের ক্ষমতা দখলের খবর৷ সামরিক সরকার জানায়, আলেন্দে আত্মহত্যা করেছেন৷
পিনোশের দুঃশাসন
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে সেনাপ্রধান এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রপতিও হন অগুস্তো পিনোশে৷ ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকা এই স্বৈরশাসক শুরু থেকেই সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে দুর্বল করতে থাকেন৷ তার শাসনামলে অন্তত ১ হাজার ৪৬৯ ব্যক্তি গুম হন।তাদের মধ্যে ১ হাজার ৯২ জন বন্দি অবস্থায় নিখোঁজ হন, ৩৭৭ জনকে গোপনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কারোই মরদেহ বা দেহাবশেষ স্বজনদের দেওয়া হয়নি।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হরণের ৫০ বছরপূর্তি
১৯৭৩-এর অভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে সালভাদোর আলেন্দেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে সরকার৷ সোমবার আলেন্দে যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, সেই লা মোনেদায়, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ভবনে এক মিনিট নীরবতা পালন করে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটিকে স্মরণ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বরিচ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা দুঃখ এবং বেদনা নিয়ে দিনটিকে পালন করি৷ সেই দিনটি যে আমাদের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷’’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ সেই দিন
চিলির ‘নাইন ইলেভেন’-এর ৫০ বছর পূর্তিতে প্রেসিডেন্ট বরিচ আরো বলেন, ‘‘অভ্যুত্থানের পর যা যা হয়েছে সেই ঘটনাগুলোকেও আমরা অভ্যুত্থান থেকে আলাদা করে দেখতে পারি না৷ তখন থেকেই শুরু হয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন৷’’ ওপরের ছবিতে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দের ম্যুরালের সামনে সমর্থকদের ভিড়৷
এক নারীর দুঃখ
মার্কিন সমর্থনপুষ্ট স্বৈরশাসক পিনোশের শাসনামলে চিলিতে ডানপন্থি ভাবধারার প্রচার-প্রসার হয়েছে৷ পিনোশের পরও দীর্ঘদিন ডানপন্থিদের বাড়বাড়ন্তে ছেদ পড়েনি৷ ১৯৭৩ ছয় বছরের কিশোরী ছিলেন এলভিরা কাডিজ৷ ১৯৭৩ ও তারপরের ঘটনাপ্রবাহ এবং বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে এলভিরা বলেন, ‘‘তখন কী হয়েছিল অনেকেই তা জানে না৷ অনেকে জানতে আগ্রহীও নয়৷ অথচ অনেকে এখনো তাদের স্বজনদের সঙ্গে কী হয়েছিল তা জানতে পারেননি৷
স্বৈরশাসক পিনোশের ‘সাফল্য
সালভাদোর আলেন্দে ও তার রাজনৈতিক দর্শনকে মুছে ফেলতে সম্ভব সব কৌশলই অবলম্বন করেছেন পিনোশে৷ সমাজে এর প্রভাব সম্প্রতি খুব ভালোভাবে টের পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট বরিচ৷ তার সরকার ১৯৭৩ সালের অভ্যুত্থানকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার পরিকল্পনা করলে পালসো চিউদাদানো নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ সম্পর্কে চিলির জনমত জানতে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে৷ সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায, শতকরা ৬০ ভাগ মানুষই দিনটি পালনে আগ্রহী নন৷
স্মৃতি এবং সত্য বিবর্জিত অন্ধকার ভবিষ্যৎ?
আলেন্দের মৃত্যুর অনেক পরে চিলির বর্তমান প্রেসিডেন্ট বরিচের জন্ম৷ জরিপ ভিন্নকথা বললেও ৩৭ বছর বয়সি রাজনীতিবিদ মনে করেন, ৫০ বছর আগের কলঙ্কময় দিনটিকে ভুলে গেলে চলবে না৷ সোমবার প্রেসিডেন্ট ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘আজকাল অনেকেই আমাদের ইতিহাসের সেই পাতা উল্টে, অতীতটাকে ভুলে এগিয়ে যেতে বলেন৷ কিন্তু স্মৃতি এবং সত্য ছাড়া তো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়৷’’