ছাত্রনেতা আনিসকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা, প্রতিবাদের ঝড়
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২হাওড়া জেলার আমতার বাসিন্দা আনিস খান৷ পরিবারের দাবি, ২৮ বছর বয়সি তরুণকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল৷ তবে স্থানীয় পুলিশকে জানালেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷
এনআরসি-সহ (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) একাধিক আন্দোলনে প্রতিবাদের মুখ ছিলেন আনিস৷ নিজের এলাকার জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছেন৷ শুক্রবার এক জলসা থেকে বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই চার ব্যক্তি আসে তার খোঁজে৷ একজনের পরনে ছিল পুলিশের পোশাক, অন্যরা ছিলেন সিভিক পুলিশের পোশাকে৷ এমনটাই দাবি আনিসের পরিবারের৷
বারবার গেট খোলার অনুরোধ করলে আনিসের বাবা এক সময় খুলে দেন গেট৷ চারজনের তিনজন দ্রুত চলে যান তিন তলায়৷ আনিস তখন বারান্দায় বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনে কিছু একটা শুনছিলেন৷ পরিবারের দাবি, রাত তিনটার দিকে ওই দুই ব্যক্তি তিন তলায় উঠে আনিসের মাথায় প্রথমে আঘাত করে, তারপর তিনতলা থেকে ফেলে দেয়৷
পরে পরিবারের পক্ষে থেকে সংবাদমাধ্যমকে আরো জানানো হয়, বারবার ফোন করা সত্ত্বেও আমতা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় ছয় ঘণ্টা পরে৷ ময়না তদন্ত পরিবারের সবার অনুপস্থিতিতে করানোর অভিযোগও উঠেছে৷
আনিসের মৃত্যুকে ঘিরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে পশ্চিমবঙ্গে ৷ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা বিক্ষোভ শুরু করেন৷
পরিবারের দাবি, পুলিশের ভূমিকা
আনিসের পরিবারের অভিযোগ, শুক্রবার রাতে পুলিশের পোশাক পরে চার জন ব্যক্তি তাদের বাড়িতে আসেন৷ তাদের তিন জন সিভিক ভলান্টিয়ার ও এক জন খাকি পোশাকে ছিলেন৷ খাকি পোশাক পরা ব্যক্তি নিজেকে আমতা থানার অফিসার পরিচয় দিয়ে আনিসের বাবাকে আটকে রাখেন৷ বাকিরা দ্রুত চলে যান তিনতলায়৷ একটু পরে ছাদ থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ পান পরিবারের লোকেরা৷ তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ওই পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তিকে বাকি তিন জন বলেন, ‘‘স্যর কাজ হয়ে গিয়েছে৷''
এরপর রক্তাক্ত আনিসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পথেই মৃত্যু হয় তার৷
আনিসের বাবা সালেম খানের অভিযোগ, পুলিশই তাঁর ছেলেকে বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে৷ ছেলে খুন হওয়ার পরে তিনি আমতা থানায় ফোন করে পুলিশকে ডাকলেও তারা আসেনি৷ তার দাবি, শনিবার ভোরে বারবার ফোন করলেও পুলিশ আসে সকাল নয়টায়৷
আনিসকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে৷ তবে পুলিশ দাবি করছে, শুক্রবার রাতে তাদের কেউ আনিসের বাড়িতে যাননি৷
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আনিসের মাথায় ক্ষতচিহ্ন দেখা গিয়েছে৷ বাড়ির লোকের দাবি, তারা থানায় পৌঁছানোর আগে ময়নাতদন্তের জন্য দেহ নিয়ে হাওড়ার উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে যায় পুলিশ৷
আনিসের বাড়ি থেকে ৮০ মিটার দূরে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে৷ সোমবার সকাল পর্যন্ত সেখান থেকে কোনো ছবি নেওয়া হয়নি বলে জানা গিয়েছে৷ ময়নাতদন্ত নিয়ে আনিসের পরিবার প্রশ্ন তুললেও পুলিশ ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনিসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়েছেন৷ তদন্তে সেই সব প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষ্য অন্যতম সহায়ক হতে পারে৷
আনিসের লেখা একটি চিঠি ‘ভাইরাল' হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ যদিও এই চিঠির সত্যতা যাচাই করেনি ডয়চে ভেলে৷ সেখানে লেখা রয়েছে, এলাকায় একটি রক্তদান শিবির আয়োজনের চেষ্টা করায় স্থানীয় তৃণমূল নেতারা আপত্তি জানান৷ কারণ আনিস তৃণমূল-বিরোধী রাজনীতি করেন৷
বিচারের দাবিতে তুমুল বিক্ষোভ ও মমতার আশ্বাস
রবিবার আনিসের বাড়িতে যান কৌশিক সেন, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়-সহ নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি৷ কৌশিক সেনের ছেলে ভারতে জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেতা ঋদ্ধি সেন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে সরব হন৷ নোংরা রাজনীতি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় আনিসের মৃত্যু নিয়ে সরব হয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরাও৷
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা আনিস হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছেন৷
এদিকে আনিস হত্যার মামলাটি জরুরিভিত্তিতে গ্রহণ করেছে আদালত৷ মঙ্গলবার এ বিষয়ে সব তথ্য জমা দিতে আবেদনকারী পক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বেঞ্চ। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাই কোর্টে ওই আবেদনের শুনানি হবে৷
নবান্নে আনিসের পরিবারকে দেখা করতে ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দেখা করতে যাবেন আনিসের বাবা৷
সোমবার আনিসের বাড়িতে যান ডিএসপি সুব্রত ভৌমিক৷ আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন তিনি৷ এদিন আমতায় আনিসের বাড়িতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতমন্ত্রী পুলক রায়৷
অন্যদিকে সোমবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের তরফে আনিসের মৃত্যুর প্রতিবাদে অবরোধ চলে দীর্ঘক্ষণ৷ আনিস হত্যার প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখায় এআইডিএসও সংগঠনও৷
বাম ছাত্র রাজনীতির অতি পরিচিত মুখ দীপ্সিতা ধরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আনিসের৷ পরবর্তী সময়ে অবশ্য আইএসএফ-এর সঙ্গে যুক্ত হন তিনি৷ গণ আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তারি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আনিস তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷
পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়েও পাননি তিনি৷ মৃত্যুর পর বাড়িতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ৷
সোমবার এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ছাত্রনেতা আনিস খানের রহস্যমৃত্যুর তদন্ত করবে বিশেষ দল৷ ১৫ দিনের মধ্যে ওই তদন্তকারী দল রিপোর্ট জমা দেবে৷ মমতার কথায়, ‘‘আনিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ভাল ছিল৷ আনিস আমাদের হেল্পও করেছিলেন৷ আনিসের পরিবারকে বিশ্বাস রাখতে বলবো৷ নিরপেক্ষ তদন্ত হবে- কথা দিলাম৷ দোষীর কোনো ক্ষমা নেই৷''
আনিসকে নিজেদের সংগঠনের সদস্য বলে দাবি করছে একাধিক রাজনৈতিক দল। আনিসকে তাদের দলের ছাত্র সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বলে দাবি করেন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি৷ কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ দাবি করেছে আনিস ছিলেন তাদের সংগঠনের সদস্য।
সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের দাবি, আনিস ছিলেন তাদের সক্রিয় সদস্য৷ বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্বে ব্রিগেড সমাবেশে দেখা গিয়েছিল আসিফকে৷
পাশাপাশি পুলিশের বয়ানে উঠে এসেছে অন্য একটি দিকও৷ ছাত্রনেতা আনিস খানের বিরুদ্ধে পকসো আইন (প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট)-এ মামলা দায়ের হয়েছিল। আদালত থেকে সমন জারি হয়। যৌন নিগ্রহ থেকে শিশুদের বাঁচাতে পকসো আইন চালু হয়েছিল ভারতে। সোমবার এমনই তথ্য দেন হাওড়ার পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) সৌম্য রায়।
আরকেসি/এসিবি (আনন্দবাজার পত্রিকা, এবিপি আনন্দ, হিন্দুস্তান টাইমস)