1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছাত্ররা গিনিপিগ, পাঠক্রম আসলেই এক রাজনীতি

২০ জানুয়ারি ২০২৩

ভারতে সরকার আসে সরকার যায়, বদলাতে থাকে স্কুলের পাঠক্রম। এই বদল ছাত্রদের সুবিধার্থে নয়, রাজনীতির প্রয়োজনে।

https://p.dw.com/p/4MTPF
ভারতের মতো বিরাট দেশে সর্বত্র শিক্ষার একই মডেল তৈরি করা কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা
ভারতের মতো বিরাট দেশে সর্বত্র শিক্ষার একই মডেল তৈরি করা কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরাছবি: Satyajit Shaw/DW

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি দলগুলি কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে কিছু সভার আয়োজন করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার যে নতুন শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতেই এই উদ্যোগ। যদিও বামেদের এই আয়োজন কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়ে দলের ভিতরেই নানা আলোচনা চলছে। আদৌ বিষয়টি নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে কি না, তা নিয়ে উঠেছে অজস্র প্রশ্ন।

আসলে পৌঁছানো যায় না। একুশ শতকের গোড়ায় যখন কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এসেছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরে, তখন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন মুরলী মনোহর যোশী। তিনিও মনে করতেন ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা দরকার। কেন্দ্রীয় শিক্ষাবোর্ডের পাঠ্যপুস্তকে তিনি আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। দেখা গেছিল, এনসিইআরটি-র বইয়ে ইসলামিক ভারত, অর্থাৎ সুলতান এবং মুঘল আমলের চ্যাপ্টারগুলিকে যথাসম্ভব ছোট করে দেওয়া হয়েছিল। সেই জায়গায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল মারাঠা এবং রাজপুত রাজাদের ইতিহাস। প্রতিবাদ তখনো হয়েছিল। তবে তাতে বিশেষ লাভ হয়নি।

কেন্দ্রের বর্তমান সরকার অবশ্য গোটা বিষয়টিকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ইতিহাসের ধারা বদলে দেয়ার খোলাখুলি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, একাধিক রাজ্যের বিজেপি সরকার বদলে দিচ্ছে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক। বদলে দেয়া হচ্ছে সমাজবিজ্ঞান এবং সাহিত্যের চ্যাপ্টার। উত্তরপ্রদেশে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা। সেখানে ঢোকানো হয়েছে পতঞ্জলি-খ্যাত রামদেব বাবার রচনা। দক্ষিণ ভারতে পাঠ্যপুস্তক থেকে টিপু সুলতানকে ছেঁটে ফেলার প্রচেষ্টা হয়েছে। ভারতের সুলতানি এবং মুঘল আমলের ইতিহাস বদলে ফেলার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন শিক্ষানীতিতেও এই বিষয়গুলির কোথাও সরাসরি কোথাও প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সভা থেকে ইতিহাসের ধারা বদলের হুঙ্কার দিচ্ছেন। বোঝাই যায়, তাদের সেই বক্তব্যে যতটা না ইতিহাসবোধ আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছে সংকীর্ণ রাজনীতির সমীকরণ।

প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রবীণ ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বেশ কিছুদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার। তিনি বলেছেন, ভারতের মধ্যযুগ, অর্থাৎ, সুলতান-মুঘল আমলকে যেভাবে মুসলিম আমল বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা ভুল। দীর্ঘদিনের ইতিহাসচর্চায় সেই সময়ের যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতগুলি উঠে এসেছিল, সেগুলিকেও গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার। কিছুদিন আগে কলকাতায় এক আলোচনাসভায় একই কথা বলেছিলেন আরেক প্রবীণ ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার। বস্তুত, ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে যে সংস্কৃতির কথা বলছে দক্ষিণপন্থি রাজনীতি, তার গোড়াতেই যে গলদ, তা বার বার তুলে ধরার চেষ্টা করছেন দেশের বিদগ্ধ পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদেরা। সম্প্রতি অমর্ত্য সেন ফের এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। এবং আবার হিন্দুত্ববাদীদের রোষানলের মুখে পড়তে হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে।

তাহলে কি বর্তমান সরকারের নতুন শিক্ষানীতি পুরোটাই খারাপ? এমনটা মনে করেন না, আরেক বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক মনে করেন, কাঠামোগত কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে এই বিলে। চার বছরের ইন্টিগ্রেটেড স্নাতস্তরের পঠনপাঠনের কথা বলা হয়েছে। এই মডেলটির সঙ্গে পশ্চিমের পঠনপাঠনের বেশ কিছু মিল আছে। এটিকে সদর্থক পরিবর্তন বলেই মনে করেন তিনি। একইসঙ্গে শিক্ষায় সমস্ত শ্রেণির সমান অধিকারের যে বক্তব্য নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, তা-ও সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু কৌশিক মনে করেন, বর্তমান ভারতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে বিভাজন বেড়েছে। ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেই এই বিভাজনের কারণ বলে মনে করেন তিনি। ফলে নতুন শিক্ষানীতিতে যা-ই বলা হোক না কেন, বাস্তবে তার প্রতিফলন আদৌ ঘটবে কি না, তা নিয়ে তার যথেষ্ট সংশয় আছে। যে কায়দায় ভারতের ইতিহাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা-ও সমর্থন করেন না কৌশিক।

ভারতের মতো বিরাট দেশে সর্বত্র শিক্ষার একই মডেল তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করেন না অধ্যাপক অভ্র ঘোষ। এলাকাভিত্তিক শিক্ষানীতির পক্ষে অভিমত তার। বস্তুত, ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। রাজ্যগুলির এবিষয়ে যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বইয়ের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের ইতিহাস বইয়ের অনেক ফারাক। এই ফারাকের পিছনেও আসলে রাজনীতির প্রভাব প্রকট।

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

দীর্ঘ বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল সরকার। জমির আন্দোলন এই পট-পরিবর্তনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু স্কুলপাঠ্যে তা নিয়ে আলোচনার পরিসর এখনো তৈরি হয়েছে কী? বহু ইতিহাসবিদ মনে করেন, এখনো সে সময় আসেনি। কারণ, অ্যাকাডেমিক স্তরে এখনো তা নিয়ে যথেষ্ট কাজ হয়নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যপুস্তকে সে ইতিহাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢুকে গেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। স্কুলের গ্রন্থাগারে মুখ্যমন্ত্রীর বই রাখা কার্যত বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে যে নতুন বই আনা হয়েছে, গ্রামের শিশুদের জন্য তা আদৌ গ্রহণযোগ্য কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এইসব বিতর্কের মধ্যেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সম্প্রতি জানিয়েছেন, পাঠ্যবইয়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম লেখা হবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতাজি একটি মন্ত্রিসভা তৈরি করেছিলেন। শপথবাক্যও পাঠ করেছিলেন। সে কথা মনে রেখেই তার এই প্রস্তাব বলে জানিয়েছেন ব্রাত্য। যদিও মনে রাখা দরকার, ভারত স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তারপরেই স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। দেশের বাইরে বসে স্বাধীনতার আগে নেতাজি যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, বাস্তব রাজনীতিতে তার সেই অর্থে কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ফলে তথ্যগতভাবে ব্রাত্যের প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

২০০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের ক্লাস নিচ্ছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক অধ্যাপক রজত রায়। সদ্য স্কুল পার হওয়া এক ছাত্র প্রথম ক্লাসেই তাকে প্রশ্ন করেছিল, ইতিহাস কী? ছাত্রকে ইএইচ কার নামক এক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদের একটি বই পড়তে বলেছিলেন অধ্যাপক। বইয়ের নাম-- হোয়াট ইজ হিস্ট্রি। এরপর একটি উদাহরণ দিয়েছিলেন রজত। একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে কীভাবে দুই ঐতিহাসিক দুইভাবে ব্যাখ্যা করেন, তা বুঝিয়ে ছিলেন। সবশেষে বলেছিলেন, সমাজবিজ্ঞানে একই ঘটনার আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা হতেই পারে, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা অবশ্যই দাঁড় করাতে হবে তথ্যের উপর। ব্যাখ্যার বদল হয়, তথ্যের হয় না। যা তথ্যনিষ্ট নয়, তা সংকীর্ণ রাজনীতি, ইতিহাস নয়।

স্কুলপাঠ্যের কাজ ব্যাখ্যা দেওয়া নয়। ছাত্রছাত্রীদের সামনে তথ্য তুলে ধরাই তার প্রথম এবং প্রধান কাজ। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তর থেকে সেই তথ্যের ব্যাখ্যা নিয়ে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। স্কুলস্তরেই যদি সেই ব্যাখ্যা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকার আসলে এক রাজনীতির খেলা খেলছে। গোটা ভারতজুড়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সেই রাজনীতিটাই হচ্ছে কেবল। ছাত্রছাত্রীরা সেখানে গিনিপিগমাত্র। দেখুন ২০১৯ সালের ছবিঘর... 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান