‘ছায়েদুল হকের অপসারণ চাই’
৪ নভেম্বর ২০১৬ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে ব্যাপক হামলার পর থেকে গত কয়েকদিনে আরো কয়েক জায়গায় হামলা হয়েছে৷
রংপুরে হামলা হয়েছে৷ হামলার প্রতিবাদও হয়েছে সেখানে৷
ঠাকুরগাঁও সদরের একটি মন্দিরেও হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে৷ বৃহস্পতিবার রাতে নারগুন ইউনিয়নের পোকাতি পশ্চিমপাড়া গ্রামে সার্বজনীন বিষ্ণু মন্দিরে এই হামলা হয় বলে ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি মশিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান৷
গোপালগঞ্জে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে বখাটেরা৷ তার প্রতিবাদ করায় চলে মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর৷
বরিশালের বানারীপাড়ায় কেন্দ্রীয় হরিসভা মন্দিরে দুর্গা-সরস্বতীসহ ৯টি প্রতিমা কুপিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়৷ মন্দিরের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত করা অন্তত একজন দুর্বৃত্তকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে পুলিশ৷
এদিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং মাধবপুরে হিন্দুদের বাড়ি এবং মন্দিরে হামলা, ভাংচুরের প্রতিবাদে সারা দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ৷ তবে সারা দেশে প্রতিবাদ শুরুর আগে আবার হামলা হয়েছে নাসিরনগরে৷
অথচ হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার কোনো পদক্ষেপের খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷
বরং সরকারের মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী মোঃ ছায়েদুল হক ঘটনার তিনদিন পর সেখানে গিয়ে বলেছেন, ‘‘মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে৷ আর এ ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতিরঞ্জিত করছে সাংবাদিকরা, অথচ ঘটনা কিছুই না৷''
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে তাঁর এই বক্তব্য৷
মনিরুজ্জামান খান মন্ত্রীর অপসারণ দাবি করে লিখেছেন, ‘‘মিঃ মেছো মন্ত্রী, ‘মালাউন' শব্দের অর্থ ‘লানতপ্রাপ্ত' বা ‘অভিশপ্ত'! সে অর্থে মালাউন কারা? যারা আক্রমণের শিকার নাকি যারা আক্রমণকারী? এ ঘটনাটি কিছুই না? সাংবাদিকরা ঘটনাটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছেন! নিজেকে অন্ধ-বধির ভাবলে আর কীইবা বলার থাকে?''
ইফতেখার মাহমুদ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে ছায়েদুল হকের প্রশ্নবিদ্ধ অতীতের কিছু অধ্যায় তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘‘পয়েন্ট টু বি নোটেড, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ছায়েদুল হককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল (বিষয়টি শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কিনা জানা নেই)৷ এর কারণ ছিল, নাসিরনগরের হরিপুর ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ‘রাজাকারপুত্র' ফারুক মিয়াকে একক সিদ্ধান্তে মনোনয়ন দিয়েছিলেন বর্তমানে হিন্দুদের ‘মালাউনের বাচ্চা' বলে কটূক্তিকারী ছায়েদুল হক৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকারদের তালিকায় ফারুকের বাবা তাজুল ইসলাম ওরফে তাইজ উদ্দিনের নাম রয়েছে৷''
তাঁর এ দাবির যথার্থতা প্রমাণ করতে অতীতে প্রচারিত খবরের লিংকও দিয়েছেন তিনি৷
তারপর লিখেছেন, ‘‘ঐ নাসিরনগরেই বর্তমানে হিন্দু বাড়ি লুট হয়েছে, ভাংচুর করা হয়েছে, মন্দির ভাঙা হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত আজ হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে৷ ছায়েদুল হকের অপসারণ চাই৷''
মনোয়ার রফিরও একই দাবি৷ এ বিষয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং নীরবতার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘‘আপনাকে ধন্যবাদ, মাননীয় মন্ত্রী৷ এই ‘মালাউন' নিধন কার্যক্রমে প্রশাসনের অংশগ্রহণ এবং অবস্থান সত্যি প্রশংসনীয়৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো চুপ থেকে মৌন সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন, আশা করি সরকারের সর্বস্তরের নেতা-নেত্রীগণও সরবে অথবা নীরবে এই সওয়াব হাসিলে শরীক হবেন৷ আসুন, ‘মালাউন' মুক্ত দেশ গড়ি৷''
বিপুল রুদ্র লিখেছেন, ‘‘২০১৬ সাল চলছে, কিন্তু ছবিগুলো দেখে মনে হয় আমরা ১৯৭১-এ আছি৷ সংগৃহীত এই ছবিগুলো বি.বাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার সাক্ষ্য বহন করছে৷ বিশেষ মহলের ষড়যন্ত্রের ফল এটি৷ লক্ষ্য সেই হিন্দু সম্প্রদায়৷ উগ্র ধর্মান্ধ কিছু মুসলিম নামধারী পশু হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, প্রতিমা, বাড়িঘর, নারীদের উপর হামলা চালিয়ে কী করেছে তা ছবিগুলোই বলছে৷ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতাসীন৷ সেই দলের সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে টিভিতে যে চেহারায় চিৎকার করে গালিগালাজ করতে দেখলাম, তা দেখে তাঁকে আমার ইতর শ্রেণির প্রাণি বলেই মনে হলো৷ আর এই ইতর প্রাণিটি এই সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী৷ বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকারে এসব ইতর শ্রেণির মানুষ কীভাবে, কেন মন্ত্রী পদমর্যাদা পায় তা আমার বোধগম্য নয়৷''
ড. ইমরান সরকারও এ বিষয়ে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘গণমাধ্যমে সরাসরি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ‘মালাউনের বাচ্চা' বলার পরও কীভাবে ছায়েদুল হক মন্ত্রী থাকে, এটা আমার বোধগম্য নয়৷ অবিলম্বে এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করার জোর দাবি জানাচ্ছি৷ আজ আওয়ামী লীগের জায়গায় যদি বিএনপি-জামায়াতের কোনো নেতা প্রকাশ্যে এভাবে ‘মালাউন' শব্দটি ব্যবহার করতো তাহলে সারাদেশে তোলপাড় হয়ে যেতো; গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীরা তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলতেন! অথচ এই ঘৃণ্য অপরাধের পরও সবাই একদম চুপ, কারণ সে আওয়ামী লীগ, কী বললে আবার কী হয়ে যায়! এক দেশে দুই নিয়ম চলবে না৷ এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীকে মন্ত্রিসভায় রাখলে আওয়ামী লীগকে স্বীকার করে নিতে হবে তারা একটা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল৷ আর তা না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কথা পরিষ্কার৷''
ইমরান খান মুন্না তাঁর দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টের শেষদিকে লিখেছেন, ‘‘আধুনিক বাংলা ডিজিটাল বাংলার মুখ থেকে শুনলাম ইনি একজন পশু..
গরু-ছাগল মন্ত্রী!!!... প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, এখনো অনেক সময় আছে আগাছা উপড়ে ফেলুন, না হলে সাপের দংশন গোটা জাতিকে কেলাবে৷''
শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘লোকটাকে দেশের পশু-প্রাণী সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আর লোকটা পশু-প্রাণী সংরক্ষণ করতে গিয়ে নিজেই পশু মানে রাম ছাগলে পরিণত হয়েছে৷ ... রাম ছাগলটাকে শুধু মন্ত্রী পরিষদ থেকেই নয়, দল থেকেও বহিষ্কার করা হোক৷''
মোহাম্মদ ফারুকের প্রশ্ন, ‘‘মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক এই পাকির গুপ্তচর কী করে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়! এই ধরনের ... লোকের বত্তব্যের কারণে উগ্রপন্থি মৌলবাদিরা সাম্প্রদায়িক হামলা করার সাহস পাচ্ছে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করে বলছি, সরকারের ভিতরে লুকিয়ে থাকা এই ধরনের মুখোশধারী পাকি গুপ্তচরদের খুঁজে বের করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিন৷ যদি এখন থেকে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এরাই একদিন জাতীয় জারজ খন্দকার মুস্তাকের রূপ ধারণ করবে৷''
ব্লগার অমি রহমান পিয়াল মনে করেন, ‘‘ছায়েদুল-মোজাম্মেলরা থাকলে দেশে আর জঙ্গি লাগবো না...''
হিন্দুদের মন্ত্রী ‘মালাউন' বলায় ক্ষুব্ধ হয়ে অনেকে মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও নিজেকে ‘মালাউন' হিসেবে তুলে ধরছেন৷ তাঁরা মনে করেন, কোনো সভ্য সমাজে যা মানায় না, মন্ত্রীর এমন আচরণের প্রতিবাদ জানানোর জন্য ‘মালাউন' হয়ে যাওয়াই উত্তম৷
সংকলন: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: জাহিদুল হক