জঙ্গিরা আবার শক্তি সঞ্চয় করছে কিভাবে?
১ এপ্রিল ২০১৭বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন নিহত হওয়ার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত হয়৷ আর পুলিশ দাবি করে, বাংলাদেশে জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে৷ নতুন হামলা করার মত শক্তি নাই তাদের৷ কিন্তু মধ্য মার্চ থেকে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জঙ্গিদের নতুন এক শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে৷ আর এই পর্যায়ে জঙ্গিবিরাধী অভিযানের মধ্যেই সিলেটে র্যাবের এক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সাতজন বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন৷ তাই এখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আদৌ কি জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে? তাদের নেতৃত্ব কি দুর্বল হয়েছে? রিক্রুটমেন্ট কি বন্ধ হয়েছে?
জঙ্গিদের নতুন রূপ
গত ১৬ মার্চ খেকে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুমিল্লায় সাতটি সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ৷ একই সময়ে ঢাকায় হয় তিনটি সন্দেহভাজন আত্মঘাতী হামলা৷
১৬ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় ‘ছায়ানীড়' ও ‘সাধনকুটির' নামের কাছাকাছি দু'টি বাড়িতে দু'টি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ৷ পরে পুলিশের সোয়াট টিমের অভিযানে চার সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়৷
২৩ মার্চ সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলে আরও একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ৷ প্যারা-কমান্ডোরা চার দিনের অভিযানে তাদের পরাস্ত করে৷ ২৮ মার্চ সেনাবাহিনীর অভিযান শেষ হয়৷ এখানে একজন নারীসহ চারজন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়৷ অভিযানের দ্বিতীয় দিন আতিয়া মহলের অদূরেই বোমা বিস্ফোরণে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধাল লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ সাতজন নিহত হন৷ জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এটা জঙ্গিদের সবচেয়ে বড় পাল্টা আঘাত৷
সিলেটের জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে অভিযান শেষ দিন (২৮ মার্চ) গভীর রাতে মৌলভীবাজার শহর ও শহরতলীর দুটি বাড়িতে পৃথক দুটি সম্ভাব্য জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ৷ এরমধ্যে মৌলভীবাজার সদর থানার নাসিরপুরগ্রামে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়৷ ওই আস্তানা থেকে অভিযান শেষে চার শিশু, দুই নারী এবং এক পুরুষের ছিন্ন ভিন্ন লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷ আর মৌলভীবাজার শহরে বড়হাটের অভিযানে এক নারীসহ তিন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছে৷
এদিকে, বুধবার দুপুরে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে একটি ভবনে আরো একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ৷ তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় অভিযান শেষে পুলিশ জানায় আস্তানায় কাউকে পাওয়া যায়নি৷ তারা দাবি করে, দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি ছিল৷ তবে তারা আগেই পালিয়েছে৷ ওই বাড়ি থেকে পুলিশ কিছু বিস্ফোরক উদ্ধার করে৷
সিলেটের জঙ্গি আস্তানার ঘটনার আগে ঢাকা মহানগরীতে একসপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে৷ ১৭ মার্চ আশকোনায় র্যাবের নির্মাণাধীন সদর দপ্তরে, ১৮ মার্চ খিলগাঁও-এ র্যাবের চেকপোস্টে এবং ২৪ মার্চ এয়াপোর্টের সামনে পুলিশ বক্সের কাছে৷ তিনটি ঘটনায় তিনজন আত্মঘাতী জঙ্গি নিহত হয়৷ শেষের ঘটনাটি আসলে সিলেটের ঘটনা শুরুর ১২ ঘণ্টা পরে৷ সিলেটের ঘটনা চলমান অবস্থায় ঢাকার বিমানবন্দরের ঘটনা ঘটে৷
নতুন পর্যায়ে জঙ্গিদের এই তৎপরতায় ১৫ দিনের মধ্যে মোট ঘটনা ঘটল ১০টি৷ আর এই ঘটনায় যারা আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে এবং আস্তানায় আত্মঘাতী প্রতিরোধ গড়ে নিহত হয়েছে তারা বয়সে তরুণ৷ পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘হলি আর্টিজানের ঘটনার পর রাজধানী ঢাকায় বাসাভাড়া নেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে৷ তাই তারা রাজধানীতে অবস্থান না করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে৷ তারা অনেকটা ভ্রাম্যমাণ হয়ে পড়েছে৷''
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় যে তিনটি আত্মঘাতি হামলার ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরা কেউই ঢাকায় অবস্থান করেনা৷ তারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিল৷ এয়ারপোর্টের সামনে সন্দেহভাজন আত্মঘাতী এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেই হামলার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল৷
‘জঙ্গিরা শেষ হয়ে যায়নি'
হলি আর্টিজানের ঘটনার পরপরই বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হলেও দেখা যাচ্ছে তারা আবারো শক্তি সঞ্চয়ে সক্ষম হয়েছে৷ কিন্তু কিভাবে? জঙ্গি বিষয়ক গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান এই প্রশ্নের জবাবে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জঙ্গিরা শেষ হয়ে গেছে এ ধরনের তথ্য আমরা পাচ্ছিলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তারা শেষতো হয়ই নাই, উল্টো তারা অনেক বেশি শক্তিশালী এবং পাল্টা আঘাত হানছে৷ শুধু তাই নয়, তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট বড় আস্তানা গড়ে তুলেছে৷ তারা ছড়িয়ে পড়েছে৷ আমরা মনে হয় জঙ্গিদের সাংগঠনিক কাঠামোর ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিক ধারণা নিতে পারেনি বা পায়নি৷ প্রকৃতপক্ষে তাদের নেতৃত্ব ঠিক করা থাকে৷ কার পর কে দায়িত্ব নেবে৷ তাই কোনো নেতা বা কমান্ডার শেষ হয়ে গেলেই জঙ্গি শেষ হয়না৷''
তিনি বলেন, ‘‘জেএমবিতে আগে বয়স্ক ও তরুণ দু'ধরনের নিয়োগই ছিল৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তরুণরাই ঝুঁকছে৷ এর একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আছে৷ বিশ্বব্যাপী জঙ্গি তৎপরতার যে প্যাটার্ন তা তরুণদের একাংশকে জঙ্গিবাদে টানছে৷ আর বাংলাদেশেও এর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে৷''
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম মনে করেন, ‘‘জঙ্গি শেষ হয়ে গেছে এটা ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক কথা৷ আসলে জঙ্গি এত সহজে শেষ হয়না৷ এটা ম্যালেরিয়া রোগ নয় ওষুধ দিলেই সেরে যাবে৷ এর বীজ কতটা গভীরে তা আমাদের জানতে হবে৷ সমাজে এটা ঢুকে গেছে৷ কোথায়, কিভাবে কতটা ঢুকেছে তা নির্ণয় করতে না পারলে শুধু অভিযানে জঙ্গিবাদ শেষ হবেনা৷ আমরা যাকে ধরতে পারছি তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাচ্ছি৷ কিন্তু এর বাইরেতো কোনো তথ্য পাচ্ছিনা৷ ফলে তাদের বিস্তৃতি সম্পর্কে আমরা পুরো ধারণা করতে পারছিনা৷ তারাতো ভুল হলেও এডামেন্ট৷ তাই তারও তাদের শক্তিকে নানাভাবে রক্ষা করতে চায়৷''
তাঁর মতে, ‘‘আকাশ যেমন সীমানাবিহীন জঙ্গিবাদও এখন সেরকম৷ তাই হতাশা, রাজনৈতিক বীতশ্রদ্ধ বা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনো কারণে তরুণরা জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে৷ তারা ভুল পথে যাচ্ছে৷ সেই কারণগুলো চিন্হিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷''