যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা
২২ ডিসেম্বর ২০১৫এমন অনাচারের ফলে সমাজে নানা রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়৷ বেড়ে যায় গুম ও খুনের ঘটনা৷ সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়, এই গুম-খুনের অভিযোগ উঠতে থাকে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে৷ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, দলের অঙ্গ সংগঠন, ছাত্র সংগঠন নানা রকমের অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতি, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে৷ অন্যদিকে দমন-নিপীড়নে বিরোধীদল দূর্বল হয়ে পড়ায়, এ সবের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ থাকে না৷ সামগ্রিকভাবে দেশে আইনের শাসন বলতে কিছু থাকে না৷ জনমানুষের জীবন হয়ে পড়ে চরম নিরাপত্তাহীন৷ ক্ষমতাসীনদের আচার-আচরণ-দাম্ভিকতায় মানুষ অতীষ্ট হয়ে ওঠে৷ কিছু অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতাসীনরা তাঁদের যাবতীয় অপরাধ আড়াল করতে চান৷
গত সাত-আট বছরে মোটামোটিভাবে বাংলাদেশে এমনই একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ এমন অবস্থায় সাধারণত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সমাজের অগ্রসর মানুষেরা৷ এর মধ্যে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-সাংবাদিক – অনেকেই থাকেন৷ তবে গণমাধ্যমই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী নাগরিক সমাজের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করছে৷
নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার মোক্ষম পন্থা
দমনে-নিপীড়নে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর, সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই নাগরিক সমাজ৷ তাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন৷ যেহেতু নাগরিক সমাজ বিবেকবান মানুষ হিসেবে পরিচিত থাকেন, সেহেতু তাঁদের প্রতিবাদের প্রভাব মানুষের উপর পড়ে৷ মানুষ সাহসী হয়ে উঠতে থাকে৷
বাংলাদেশে বর্তমানে বিরোধী দল বলতে কিছু নেই৷ দমনে-পীড়নে বিএনপি ছন্নছাড়া৷ এরশাদের জাতীয় পার্টি কোনো দলের পর্যায়েই পড়ে না৷ এদের ‘তোষামোদী দল' বলা যেতে পারে৷ তাছাড়া সরকারের নেতিবাচক, খারাপ বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোনো প্রতিবাদ নেই৷ প্রতিবাদ একমাত্র আসছিল নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে৷ বিশেষ করে সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাংবাদিক, তথা গণমাধ্যম৷ এর মধ্যে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল টেলিভিশনের রাজনৈতিক আলোচনা অনুষ্ঠান ‘টকশো'৷
তাই বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণের পর, সরকারের দায়িত্ব হয়ে পড়ে গণমাধ্যম তথা নাগরিক সমাজ নিয়ন্ত্রণ, টকশো নিয়ন্ত্রণ৷ সরকার মনে করে, নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার এটাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা৷
বর্তমানে দেশে প্রতিটি মানুষের জীবনই নিরাপত্তাহীন৷ আর গণমাধ্যম কর্মীদের জীবন আরও বেশি নিরাপত্তাহীন৷ একের পর এক ব্লগারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেই নিরাপত্তাহীনতার কিছুটা প্রকাশ দেখা গেছে৷ বাস্তবে গণমাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর৷ ব্লগারদের উপর ক্ষিপ্ত সমাজের ছোট ধর্মীয় উন্মাদ একটি অংশ৷ সত্যি কথা বলতে কি, গণমাধ্যম কর্মীদের উপর এই ধর্মীয় উন্মাদরা তো ক্ষিপ্তই, তার চেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত সরকার, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী৷ ফলে তাদের বিপদ বহুবিধ৷ ব্লগার, প্রকাশকদের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার অন্যদের ভয় দেখাতে চেয়েছে যে, পরিণতি এমন হলে কিছু করার থাকবে না৷ এর সঙ্গে সাংবাদিক, সম্পাদকদের হত্যার হুমকি, গুমের হুমকি-প্রচেষ্টা তো আছেই৷ ফলে কিছু গণমাধ্যম কর্মী অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছেন৷ গণমাধ্যম মালিকদের যেহেতু আরও অন্য ব্যবসা আছে, ফলে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে-হচ্ছে ভিন্ন পন্থায়৷ কাউকে কাউকে অন্য ব্যবসায় সুবিধা দেয়া হয়েছে-হচ্ছে৷ আবার কারো অন্য ব্যবসায় সমস্যা তৈরি করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে-হচ্ছে৷ যে সব গণমাধ্যম কর্মী এত প্রতিকৃলতার মধ্যেও সত্য লিখছিলেন, সত্য বলছিলেন, তাঁদেরও নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নানা পন্থা অবলম্বণ করা হচ্ছে৷ এছাড়া দলীয় মাস্তানদের দিয়ে অনেকের চরিত্রহনন করানো হচ্ছে, মৌখিকভাবে মালিকদের চাপ দিয়ে টকশোতে অনেককে নিষিদ্ধ করানো হয়েছে, অনেকের লেখা পত্রিকাগুলো ছাপাও হচ্ছে না৷ এমনকি বিপদে পড়ার ভয়ে অনেক পত্রিকা নিজেরাই ‘সেন্সর' করছে৷ প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের বিজ্ঞাপণ বন্ধ করিয়ে দিয়ে অন্যদের ভয় দেখানো গেছে৷ এখানেই শেষ নয়৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে কারো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এক ধরণের ভিতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে৷ তারপরও পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না৷ সরকার অবশ্য নানা উপায়ে এই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা অব্যহত রেখেছে৷
ঘুস দিয়ে অথবা ভয়-ভিতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা
লেখক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে স্বৈরশাসকরা দু'টি উপায় অবলম্বন করে থাকে৷ এক. সুযোগ-সুবিধা, অর্থ-সম্পদ দিয়ে৷ দুই. ভয় দেখিয়ে৷ অর্থ-সম্পদ দিয়ে নাগরিক সমাজের অনেককে পক্ষে নেয়ার প্রবণতা আইয়ুব খানের সময় থেকে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশে সামরিক শাসক জিয়াউর রাহমানও নাগরিক সমাজের অনেককে পদ-পদবি দিয়ে পক্ষে নিয়েছিলেন৷ তবে নাগরিক সমাজের বড় একটি অংশের চরিত্র দুষিত করে দিয়েছেন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ৷ মন্ত্রীত্ব, পদ-পদবি, ঢাকায় প্লট বাঅর্থ দিয়ে নাগরিক সমাজের অনেককে কাছে টেনে নিয়েছিলেন এরশাদ৷ যাঁদের নিতে পারেননি, তাঁদের উপর জুলুম-নির্যাতন করেছেন৷
বর্তমানে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বা পাবেন এই লোভে নাগরিক সমাজের বড় একটি অংশ সরকারের দুর্নীতি-অন্যায়-অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থন করছেন৷ যাঁরা এখনও সত্য কথা বলছেন, লিখছেন, তাঁদের নানা রকমের ভয়-ভিতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে৷ কেউ একজন নিজে ভয় না পেলে, সন্তানদের কথা বলে ভয় দেখানো হচ্ছে৷ দেশে যেহেতু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে কিছু নেই, নেই আইনের শাসন, বিপদে পড়লে আশ্রয়ের জায়গাও নেই, সেহেতু অনেকে নিজে থেকেও সতর্ক হয়ে গেছেন৷ হিসেব করে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করছেন৷ চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখছেন, কিন্তু বলছেন না, প্রতিবাদ করছেন না৷ আর যিনি বলতে চান, তাঁকে বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না৷ পত্রিকাগুলিও তাঁর লেখা ছাপতে অপারগতা প্রকাশ করছে৷
লোভি-নীতিভ্রষ্ঠ একদল তোষামোদকারী ভোটারবিহীন নির্বাচন থেকে শুরু করে, গুম-খুন, সন্ত্রাস, ব্যাংক-শেয়ার বাজার লুট – এ সব অপকর্মকে ভালো কর্ম বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন৷ সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত খারাপ সময় অতিক্রম করছে৷
বন্ধুরা, গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে আপনি কী একমত? আমাদের লিখে জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷