জর্জিয়ায় ‘নিরাপদ নয় সাংবাদিকতা'
২৮ নভেম্বর ২০২৩ঠিক সন্ধ্যে ৬টায় সম্প্রচার শুরু হবে জর্জিয়ার এমতাভারি টিভি চ্যানেলের৷ পর্দায় দেখা যাচ্ছে সঞ্চালক মিখাইল সেসিয়াশভিলিকে৷ আজকের বড় খবর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি দুর্ঘটনা, যদিও কোনো হতাহতের খবর নেই৷
কীভাবে, কোন সংবাদ পরিবেশন করা হবে, তা এমতাভারি টিভি নিজে ঠিক করে৷এই সংস্থার তিনশ কর্মী মিলে এই লক্ষ্যে লড়ে যাচ্ছেন৷ ২০১৯ সালে, তৎকালীন সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি বেশি সরকারঘেঁষা হওয়ায় এমতাভারি টিভির কর্মীরা সরব হন৷
সেসিয়াশভিলি তাদের কাজ কতটা জটিল তা বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমি এমন এক গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করি, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজনৈতিক কারণে এক বছর তিন মাস কারাবাসে কাটিয়েছেন৷''
তার একমাত্র অপরাধ, তিনি সরকারের সমালোচনা করেছিলেন৷ ‘‘আর এই ভবনের সবাই ভাবেন, এরপর আমাকে যেতে হবে'', বলেন সসিয়াশভিলি৷
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্ত?
২০২২ সালের মে মাসে এমতাভারি টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিকা গভারামিয়াকে সাড়ে তিন বছরের সাজা শোনানো হয়৷ অফিসের গাড়ির ব্যক্তিগত ব্যবহারের ফলে সংস্থাটির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়৷ কিন্তু অনেকেই এমন অভিযোগের মধ্যে ‘রাজনীতি' দেখছেন৷
ইইউ নেতৃত্ব ইতিমধ্যে গভারামিয়ার মুক্তির দাবি জানায়৷ জর্জিয়ার ইইউ সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্ব পায় বিষয়টি৷ জুন মাসের শেষে জর্জিয়ান প্রেসিডেন্ট সালোমে জুরাবিচভিলি গভারামিয়ার সাজা মকুব করেন৷
তবে সাংবাদিকদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে এখনো সন্তুষ্ট নন সেসিয়াশভিলি৷ তার মতে, ‘‘এটা কঠিন, কিন্তু আমরা একে অপরকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করি, কেন আমরা এই পেশায় রয়েছি, তা বোঝার চেষ্টা করি৷ আমি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলি, কারণ, আমরা আরো গণতান্ত্রিক, মুক্ত জর্জিয়ার জন্য লড়ছি৷''
আইনি মারপ্যাঁচ
সমীক্ষা বলছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি জর্জিয়ান ইইউ'র সদস্য হবার পক্ষে৷ রাজধানি টিবিলিসির দেওয়ালে দেওয়ালে ‘আমরা ইউরোপ' লেখা দেখা যায়৷
নভেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান কমিশন প্রস্তাব দেয় যে, জর্জিয়াকে ইইউ সদস্যপদ প্রার্থী হিসাবে বিবেচনা করা হবে, তখন দেশজুড়ে উৎসবের মেজাজ৷
কিন্তু ইইউ সদস্য হতে গেলে যে ১২টি শর্ত পূরণ করতে হয়, তার মাত্র তিনটি পূরণ করেছিল জর্জিয়া৷ ব্রাসেলস জর্জিয়াকে সতর্ক করে যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দিকে নজর দিতে হবে৷ তবুও অবিচল থেকেছে জর্জিয়া কর্তৃপক্ষ৷ চলতি বছরের শুরুতে সাংবাদিকদের সংসদের ভেতর থেকে কাজ করার অনুমতি বা অ্যাক্রেডিটেশন বন্ধ করতে আইন প্রণয়ন করে জর্জিয়া৷ ফলে, সংসদ সদস্যদের একবারের বেশি দুবার একটি কঠিন প্রশ্ন করলেই অনুমতি হারাবার আশঙ্কা দেখছেন সাংবাদিকরা৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জর্জিয়ার গবেষক মারিয়ম গেরসামিয়া এই চলকে একটি ‘আমলাতান্ত্রিক ছুরি' হিসাবে দেখছেন৷ মারিয়মের মতে, ‘‘কীভাবে সাংবাদিকদের কাজকে ছোট করা হয়, তা আমরা দেখছি৷ সাথে আমরা দেখছি কীভাবে পরিকল্পিত ক্যাম্পেনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের অসম্মান করা হচ্ছে৷''
‘জর্জিয়ায় নিরাপদ নয় সাংবাদিকতা'
রাজধানী টিবিলিসির উত্তরাঞ্চলে, শহরের ঝলমলে আলো থেকে অনেকটাই দূরে ফর্মূলা টিভির কার্যালয়৷ বলা হয়, বিরোধী পক্ষের সাথে যোগ রয়েছে এই চ্যানেলটির৷
এই কার্যালয়েই সাপ্তাহিক ব্যঙ্গধর্মী অনুষ্ঠানের কাজ সারেন মিশা এমশভিলডাদজে, যার মুখে লাগাম চাপানো অতটা সহজ নয়৷ তার চরিত্রের এই দিকটি জর্জিয়ায় তাকে জনপ্রিয় করে তুললেও, সবার প্রিয়পাত্র তিনি স্বাভাবিকভাবেই নন৷
জুনমাসে অফিস থেকে ফেরার সময় বেশ কয়েকজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি তাকে ধাওয়া করে ও রাস্তায় ফেলে মারধরও করে৷ তার চোখে বারবার আঘাত করা হয়, কিন্তু এই আঘাতের লক্ষ্য তাকে মেরে ফেলা ছিল তা মনে করেননা মিশা৷ মিশার মতে, এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল আঘাতের দৃশ্যমান চিহ্ন রেখে যাওয়া৷
মিশা এমশভিলডাদজে বলেন, ‘‘এই দেশে সবাই আমাকে চেনে৷ ফলে, গণপরিসরে আমাকে আঘাত করলে তা একটা বার্তা পাঠায়: যে আমি যদি নিরাপদ না থাকি, তার মানে কেউ নিরাপদ নয়৷ যারাই সমালোচনা করবে, তারাই সাজা পাবেন৷''
মিশার সহকর্মীরা চেষ্টা করেন অপরাধীদের খুঁজে বার করার এবং তদন্তের পর তারা জানতে পারেন যে এই আক্রমণটি জর্জিয়ার রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তরফেই সংগঠিত করা হয়৷ সংস্থার সাথে যুক্ত একজন অপরাধী সাব্যস্ত হন, কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেন৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গেরসামিয়া বলেন, ‘‘জর্জিয়ায় সাংবাদিকতা আর নিরাপদ নয়৷ এই পেশা থেকে জনপ্রিয়তাও সম্ভব নয়, বরং সাংবাদিকদের বিরক্তিকর মনে করেন অনেকে৷''
যে হারে এই পেশা ছাড়ছেন অনেকে, তা নিঃসন্দেহে জর্জিয়ার উন্নয়নের লক্ষণ নয় বলেই মনে করেন গেরসামিয়া৷
আনিয়া কখ (টিবিলিসি, জর্জিয়া)/এসএস