জলবায়ু তহবিল নিয়ে যত কথা
৩০ অক্টোবর ২০১৭আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মেকাবেলায় আলাদা দু'টি তহবিল গঠন করে৷ একটি হলো বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) এবং অন্যটি বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ)৷
বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণে বিসিসিআরএফ তহবিল এখন প্রায় স্থবির৷ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিসিসিটি তহবিলে এখন পর্যন্ত তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার৷
এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড(জিসিএফ) বা সবুজ জলবায়ু নামের আরেকটি তহবিল থেকে সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো পেয়েছে৷ কিন্তু সেই জিসিএফ-এর স্থায়ী সদস্য পদ হারিয়েছে বাংলাদেশ৷ ফলে ওই ফান্ডের টাকা আর আসছে না৷ বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্যকর অংশ গ্রহণের অভাবের কারণেই জিসিএফ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে৷
এ তহবিল থেকে বাংলাদেশের জন্য আট কোটি ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৪০ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছিল৷ আরো আট কোটি ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল৷ কিন্তু সেই অর্থ আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না৷
শিল্পোন্নত দেশগুলো এই তহবিলে ১০০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং প্রতি বছর এ তহবিল থেকে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি ডলার ছাড় করার ঘোষণা রয়েছে৷ কিন্তু এখন বাংলাদেশ এই তহবিল থেকে আর কিছু পাবে কিনা তা অনিশ্চিত৷
আর গত বছর, যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থা ডিএফআইডি বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড থেকে এক কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড ফেরত নিয়ে গেছে৷ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে ৭ কোটি ৫০ লক্ষ পাউন্ড অনুদানের ঘোষণা দেয় ব্রিটিশ সরকার৷ সেই অর্থ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড অর্থ বাংলাদেশ গ্রহণ করলেও অর্থ সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বব্যাংকের অন্তর্ভূক্তি মেনে নেয়নি বাংলাদেশ৷ এ কারণে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করেনি বাংলাদেশ৷ এরপর শর্ত নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ডিএফআইডি তাদের ছাড় করা ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড অর্থ ফেরত নেয়৷
শুধু যুক্তরাজ্য নয়, ৫ কোটি ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা ফেরত নিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ান এইড, ইউএসএআইডি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সুইজারল্যান্ড৷ ফলে বিসিসিআরএফ তহবিল এখন স্থবির৷
২০১০ সালে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ) নামের ওই তহবিলে প্রায় ১৯ কোটি ডলারের মতো জমা পড়ে৷ এর মধ্যে ১৪ কোটি ডলার দিয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে৷
বাংলাদেশে জলবায়ু তহবিলের বড় একটি অংশ খরচ করা হয় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর মাধ্যমে৷ পিকেএসএফ-এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ ওই ফান্ড ফেরত নেয়ার সময় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড তৈরি করেছিল৷ যেখানে ব্রিটেন, হউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ ১৯০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ এরমধ্যে তারা ১৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার দেয়৷ এরমধ্যে ৮৭ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়৷ এরসঙ্গে বিশ্বব্যাংকও ছিল৷ পাঁচবছরের ওই চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই ফান্ড আর ব্যবহার করা হচ্ছে না৷''
উন্নয়ন সহযোগীদের বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ) স্থবির হয়ে যাওয়ায় সরকার এখন নতুন করে জলবায়ু তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে৷ বিসিসিআরএফের মতো নতুন তহবিল গঠনের পর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হবে৷ নতুন জলবায়ু তহবিলে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে সরকার৷
জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব অনুধাবন করে এর প্রভাব মোকাবেলা করতে সরকার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আওতায় এ সংক্রান্ত আলাদা একটি অনুবিভাগ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ নাম দেওয়া হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন অনুবিভাগ৷ এছাড়া গত ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় পরিবেশ কমিটির চতুর্থ সভায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন নাম নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷
জাতিসংঘের আইপিসিসি, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য অনেক সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি আরো বাড়ানোর জন্য এবং ভূমিকা আরো জোরদার করার জন্য আলাদা অনুবিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে৷
জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডে সরকারের রাজস্ব বাজেট হতে ২০০৮-২০১০ অর্থবছর হতে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷
ট্রাস্ট ফান্ড হতে সারাদেশে বাস্তবায়নের জন্য ৫০১টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে৷ তারমধ্যে ২১৩টি প্রকল্প সফলভাবে শেষ হয়েছে৷
বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গত ৯ জুলাই সংসদে জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি এর কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে৷ চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উপকূলীয় এলাকায় বাস্তবায়নের জন্য সরকারি সংস্থা বা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করলে তা বিবেচনা করা হবে৷
ট্রাস্ট ফান্ড থেকে উপকূলীয় ১৯টি জেলায় প্রায় ১২৩০ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে ৫২টি প্রকল্প শেষ হয়েছে৷ ১৩৩টি প্রকল্প ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা হবে৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জলবায়ু তহবিল বরাদ্দ এবং এর গুণগত মান নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করে৷ তাতে বলা হয়, জলবায়ু তহবিল বরাদ্দে গুণগত মানের বদলে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি কাজ করছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়,‘‘স্থানীয় জলবায়ু বিপন্নতা ও বরাদ্দের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে৷''
গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘জলবায়ু অর্থায়ন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান: প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন' ৷ তাতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় স্থানীয় সরকারের ১০৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে৷ এর মধ্যে মহানগরে তিনটি, পৌরসভায় ৯১টি ও জেলা পরিষদে ১৪টি প্রকল্পে বাজেট প্রায় ৩৫৪ কোটি টাকা৷ বিপন্নতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তহবিল বরাদ্দ হচ্ছে না৷ রাজনৈতিক প্রভাব বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে৷ যেখানে ঝুঁকি বেশি, সেখানে বরাদ্দ কম, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কারণে ‘পছন্দমতো প্রকল্প' নিয়ে বরাদ্দ বেশি করায় ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হচ্ছে৷ এতে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এসব প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে৷ জনগণের সম্মতি ছাড়া নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিলে তার সুফল পাওয়া যাবে না৷
টিআইবি ট্রাস্ট ফান্ড-এর ছয়টি প্রকল্প নিয়ে গবেষনা করে৷ এর মধ্যে চারটি প্রকল্পেই প্রভাব খাটিয়ে অনুমোদন দেয়ার মতো অনিয়ম পাওয়া গেছে৷ এগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাস্তবায়ন করছে৷ পাউবো'র স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তা ছয়টি প্রকল্পই পরিদর্শন করেছেন, তবে এই তদারকি সংক্রান্ত কোনো লিখিত প্রতিবেদন নেই৷ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ দল এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষন এবং মূল্যায়ন বিভাগ কর্তৃক গবেষণাধীন কোনো প্রকল্পেই পরিবীক্ষণ করা হয়নি৷ কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ের নিরীক্ষা দল কর্তৃক গবেষণাধীন কোনো প্রকল্পেই নিরীক্ষা করা হয়নি৷ গবেষণায় কার্যকর অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতিও চিহ্নিত করা হয়৷
গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সম্পর্কে জানেন না; প্রকল্প এলাকায় তথ্যবোর্ড স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি এবং তথ্যবোর্ডে অপর্যাপ্ত তথ্য৷
প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে চারটি প্রকল্পই অনুমোদনের সময় বিভিন্ন পর্যায় থেকে সুপারিশ এবং প্রভাব খাটানো হয়েছে৷ এর মধ্যে একটি প্রকল্পে জনৈক সচিব, একটি প্রকল্পে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রীর আত্মীয় ও স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) এবং দুটি প্রকল্পে স্থানীয় এমপি প্রভাব খাটিয়েছেন৷
জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ওয়েব সাইটে গিয়ে বন অধিদপ্তরের ১১টি চলমান প্রকল্পের নাম ও বিস্তারতি পাওয়া যায়৷ সেগুলো হলো:
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ভান্ডারিয়া উপজেলাধীন চরখালী ফেরীঘাট সংলগ্ন চর এলাকা বনায়নের মাধ্যমে ভূমির উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা প্রকল্প৷
২. জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (খসড়া) সংশোধন ও পরিমার্জন প্রকল্প৷
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুরের বর্ধিতাংশে বায়োডাইভারসিটি পার্ক উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প
৪. পিরোজপুর রিভারভিউ ইকোপার্ক (ডিসি পার্ক)-এর সংস্কার ও সৌন্দর্য্যবর্ধন কাজ ও বনায়ন প্রকল্প
৫. ফেনী সদর উপজেলাধীন কাজীরবাগ ইকো-পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে জনসাধারনের বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি প্রকল্প৷
৬.জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উপকূলীয় অঞ্চলের পিরোজপুর জেলাধীন ভান্ডারিয়া উপজেলার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সবুজ বেষ্টনী সৃজনের লক্ষ্যে মরাখালসমূহ পুনঃখনন এবং বনায়ন ও পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প৷
৭. ভাণ্ডারিয়া থানা ইকো-পার্ক উন্নয়ন ও সংস্কার
৮. কুরী-মুকরী ইকোর্পাক স্থাপন প্রকল্প
৯. সুন্দরবন সংরক্ষিত বনে স্মার্ট পেট্রোলিং
১০. মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে সৌর বেষ্টনী স্থাপন
১১. পিরোজপুর পুলিশ লাইন ইকো পার্ক নির্মাণ প্রকল্প
এর মধ্যে দেখা যায়, পিরোজপুর জেলাতেই রয়েছে ৫টি প্রকল্প৷ এর মধ্যে ওই জেলার একটি উপজেলা ভান্ডারিয়ার রয়েছে তিনটি প্রকল্প৷ আর বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায়৷
২০১২ সালে পাঠক প্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানায়, ‘‘জলবায়ু তহবিল পাওয়া ৬৩ এনজিওর অর্ধেক অনভিজ্ঞ৷''
তারা জানায়, ‘‘অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকার ৬৩টি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা তহবিল দিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে৷ অনুমোদন পাওয়া এনজিওগুলোর ৩১টির জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা নেই৷ ১০টি এনজিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত৷ সরকারের অন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল এমন প্রতিষ্ঠানও তহবিল পেয়েছে৷''
তখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা তহবিল অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ)-এর ১৬ সদস্যের পরিচালনা বোর্ড৷ অনুমোদন পেয়েছে এমন ১০টি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক, সভাপতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা৷ এসব এনজিওকে তহবিল দিতে দলটির শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী নেতা থেকে স্থানীয় সাংসদেরা সুপারিশ করেছেন৷ এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি এনজিওর বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে৷
জলবায়ু তহবিলের প্রকল্প নিয়ে টিআইবি'র গবেষণা দলে ছিলেন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিচার্স অ্যান্ড পলিসি) নাহিদ শারমিন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার নামে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার অধিকাংশই প্রচলিত উন্নয়মূলক প্রকল্প, যা এমনিতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় আগে থেকেই করতো৷ যেমন ড্রেন, কালভার্ট, সংযোগ সড়ক প্রভৃতি নির্মাণ৷ আসলে প্রচলিত উন্নয়নমূলক কাজগুলোই এখন জলবায়ু তহবিলের টাকা থেকে করা হচ্ছে৷ এটা এমন নয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বিশেষ কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আর এই কাজগুলো পেতে হলে মন্ত্রী- এমপির সুপারিশ বা তদবির ছাড়া হয় না৷ আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মন্ত্রীর সঙ্গে লিয়াজো করে প্রজেক্ট পাশ করা হয়েছে৷ একটি প্রজেক্ট সাবমিট করে তারপর তার গুরুত্ব অনুযায়ী প্রজেক্ট পাশ হয় না৷ ফলে যেটা হয়, যেখানে প্রকল্প প্রয়োজন সেখানে হয় না৷ কারণ, সেখানে তদবির করার লোক নাই৷ আবার তদবিরের কারণে অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্টও পাশ হয়৷''
টিআইবি'র এই গবেষক বলেন, ‘‘এই কাজগুলো আবার বাস্তবায়ন হয় টেন্ডারের মাধ্যমে৷ কিন্তু এটা আসলে সাজানো৷ বাস্তবে যারা ঠিকাদার হিসেবে কাজ পান, তারা মন্ত্রী-এমপি অথবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়৷ ফলে কাজে প্রচুর নয়ছয় হয়৷ মান খারাপ হয়৷ আবার প্রকল্পের কাজ যে কর্মকর্তরা মনিটরিং করতে যান, তাদের যানবাহন দেন ঠিকাদারা৷ এখান থেকেই নানা পক্ষের সুবিধা নেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘আসলে জলবায়ু তহবিলের নামে যে কাজ হচ্ছে তা নামেই হচ্ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য সেই অর্থে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না৷''
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)-এর নির্বাহী পরিচালক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এম আতিক রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ) এখন আসলে আর কার্যকর নাই৷ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মতবিরোধের কারণে ওই ফান্ড থেকে আর কোনো অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না৷ অন্যদিকে সরকার যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) গঠন করেছে, সেখানেও আর আগের মতো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় না৷ কারণ, এই ফান্ডের টাকার ব্যবহার নিয়ে সরকার এবং সরকারের বাইরে নানা রকম কথা আছে৷ প্রকল্পগুলো নিয়ে নানা আলোচনা আছে৷ পত্রিকায় নানা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে৷ টিআইবি গবেষণা করে দেখেছে৷ এই ফান্ডের প্রকল্পগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ বাংলাদেশের জন্য এখন একমাত্র ভরসা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)৷ বাংলাদেশ এখন আর এর সদস্যপদে না থাকলেও এখান থেকে ফান্ড পেতে কোনো বাধা নাই৷ আর বাংলাদেশ এখন জিসিএফ-এর ফান্ড পাওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা এখন আমাদের টাকা দিতে চায়, তারা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডেই টাকা দিচ্ছে৷ কোরিয়ার এর সদর দপ্তর৷ এরই মধ্যে ১২-১৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার সেখানে জমা পড়েছে৷ এটা একটা বিশাল ফান্ড৷ এবং ২০২০ সাল থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে৷ কিন্তু বাংলাদেশকে এই ফান্ড আনতে হলে প্রজেক্ট সাবমিট করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আনতে হবে৷ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দক্ষিনাঞ্চলে সাইক্লোন সেন্টারের জন্য এলজিইডি'র একটি প্রকল্প তহবিল পেয়েছে৷''
ড.আতিক রহমান জানান, ‘‘কার্বন নিঃসরন কমানো এবং অ্যাডাপটেশন(অভিযোজন) এই দুই ধরণের কাজে তহবিল দেবে৷ আর তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যে-ই সঠিক প্রকল্প দিতে পারবে, তাকেই তারা ফান্ড দেবে৷ বাংলাদেশ সেই ফান্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এক্সপার্টদের নিয়ে কাজ করছে৷ আমি আশাবদী বাংলাদেশ এই তহবিল পাবে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. আতিক বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সঠিক প্রকল্প নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে৷ আমাদের সুনাম আছে৷ সেটা যেন নষ্ট না হয়৷ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ৷ তাই আমাদের প্রস্তুতি হতে হবে অনেক ভালো৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷