জলবায়ু তহবিলের টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে?
১১ নভেম্বর ২০২৪সড়ক বাতি স্থাপন, পার্ক তৈরি, পুকুরের ঘাট বাঁধানোসহ নানা কাজে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এমনকি জলবায়ুর টাকায় ভবন বানিয়ে ব্যক্তিগত রিসোর্টে পরিণত করারও নজির আছে৷
পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালি ইউনিয়নে গত সরকারের আমলে ইকো রিসোর্টের নামে ১০০ বিঘা জমিতে একটি ব্যক্তিগত রিসোর্ট ও পার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল৷ সরকারি খাস জমির ওপর এই পার্ক করা হয়েছে জলবায়ু তহবিলের টাকায়৷ ভান্ডারিয়া উপজেলা সদরের রিজার্ভ পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে, ঘাটও বানানো হয় জলবায়ুর টাকায়৷ ওই পুকুরে রঙিন মাছ, পানির ফোয়ারাও বানানো হয়েছে৷ অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট লবণাক্ত পানির কারণে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার কোনো প্রতিকার করা হয়নি৷
একইভাবে জলবায়ু ট্রাস্টের তহবিলে খুলনায় গড়ে তোলা হয়েছে শেখ রাসেল ইকো পার্ক৷ খুলনার রূপসা এলাকায় প্রায় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই পার্ক তৈরি করা হয়৷
খুলনার তিন উপজেলায় এই তহবিলের টাকায় লাগানো হয়েছে সৌর বাতি৷ কিন্তু ওই এলাকায় এই ধরনের কোনো প্রকল্পই ছিলো না৷ ছিলো সুন্দরবন এবং আশপাশের উপজেলায় সুপেয় পানির প্রকল্প৷
ভোলার চরফ্যাশনে একইভাবে জলবায়ু ট্রাস্টের টাকায় তৈরি করা হয়েছে সুউচ্চ ‘জ্যাকব টাওয়ার' ও ইকোপার্ক৷ ভোলার চর কুকরি-মুকরিতেও জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় করা হয়েছে বিনোদন কেন্দ্র৷
২০২০ সালে জলবায়ু তহবিলের টাকায় কেনা চারটি বাস আগারগাঁও পরিবেশ অধিদপ্তরে পড়ে থেকে ধুলোবালিতে নষ্ট হয়ে গেছে৷ ওই বাস চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ সচেতনতার কাজে লাগানোর কথা ছিলো৷
ক্ষতিগ্রস্তদের কথা
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু৷ ওই এলাকার মানুষ পানীয় জলের সংকটে আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে৷ মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও আরও পাঁচটি ইউনিয়নে চলছে পানীয় জলের হাহাকার৷ পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, ‘‘এলাকায় কোনো সুপেয় পানি নেই৷ সরকারের দিক থেকেও উদ্যোগ তেমন নাই৷ অনেক কষ্টে বহু দূর থেকে পানি এনে জীবন চলছে৷'' তিনি জানান, পানি সংকটের কারণে উপজেলার অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন৷ নারী ও শিশুদের ৭০ শতাংশই নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত৷ ফসলি জমিও লবণ পানির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান তিনি৷
ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা সামিউল মনির বলেন, ‘‘লবণ পানির কারণে এখানে গবাদি পশুর খাদ্যেরও সংকট রয়েছে৷ অনেকেই কাদাপানির মধ্য দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহের চেষ্টা করেন৷ তারা কাদাপানি সংগ্রহ করেন৷ পরে তা থিতিয়ে উপর থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়৷''
শ্যামনগর উপজেলার জলবায়ু পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ আশেক ই ইলাহী বলেন, ‘‘জলবায়ু ট্রাস্টের কোটি কোটি টাকা থাকলেও তা আমাদের জন্য এতদিন খরচ হয়নি৷ এই এলাকায় কোনো প্রকল্প নেয়া হয়নি৷ সুপেয় পানির কোনো উৎস তৈরি করা হয়নি৷''
সংখ্যায় জলবায়ু তহবিল
জলবায়ু তহবিলের টাকায় ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩২২টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে ২০৯টি সড়কবাতি বসানোর প্রকল্প, যা মোট প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ৷ এসব প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৩৮ কোটি টাকা৷ ২৩টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে নর্দমা নির্মাণের জন্য৷ এতে ব্যয় ৪১ কোটি টাকা৷
আর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তহবিলটির মাধ্যমে ৯৬৯টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে৷ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা৷
গত বছরের ১৮ জুন সংসদে জানানো হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ওই সময় পর্যন্ত সর্বমোট তিন হাজার ৮৫২ কোটি টাকা জলবায়ু তহবিলে বরাদ্দ করা হয়েছে৷ এই অর্থ দিয়ে ৮৫০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে৷
গত ২০ অক্টোবর প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তখন দেশে জলবায়ু খাতে কোনো ঋণ ছিল না৷ গত ১৫ বছরে এ খাতে জনপ্রতি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬১ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯ হাজার ৪৮৫ টাকা৷ ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ১৪. ৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে, যা মোট ঋণের ৯.৭ শতাংশ৷
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকার শীর্ষ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ অলাভজনক সংস্থা জার্মান ওয়াচের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে সাত নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ৷
বিশ্লেষকদের কথা
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, ‘‘আসলে এই খাতে নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার কোনো সম্পর্ক নেই৷ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ খরচ করা হয়েছে৷''
তার কথা, ‘‘শেখ হাসিনার সময়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যে জলবায়ুর জন্য অনেক কাজ হচ্ছে৷ আসলে জনস্বার্থে কোনো কাজ হয়নি৷ যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে এখন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন৷''
বুয়েটের অধ্যাপক এবং জলবায়ু ও পরিবেশবিদ ড. আহসান উদ্দিন বলেন, ‘‘আমাদের এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আসলে পরিকল্পনামাফিক কোনো কাজ হয়নি৷ এর কোনো চেষ্টাও হয়নি৷ আর যখন ফান্ড তৈরি করা হলো তখন তার জন্য জাতীয় প্রয়োজনে কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনাও তৈরি করা হয়নি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখানে ট্রাস্ট গঠনের পর খেয়ালখুশি মতো অর্থ খরচ করা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া হয়েছে৷ প্রয়োজনীয় কাজ করা হয়নি৷''
এবিষয়ে কথা বলার জন্য গত সরকারের সময়ে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের দায়িত্বে থাকা পিকেএসএফ-এর সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷
এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে সোমবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন৷