জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের আবহাওয়ার চরম রূপ
২৪ জুন ২০০৯ঝড়, তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ, বজ্রপাত ও সুনামির মতো দুর্যোগ ঘন ঘন বাংলাদেশের ওপর হানা দিচ্ছে৷ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের হার আগের চেয়ে বেড়েছে৷
বেশ কয়েক বছর আগে নিম্নচাপ হলে ১ বা ২ নম্বর সতর্ক সংকেত বেশি দেখানো হতো৷ এখন তা দেখানো হচ্ছে সরাসরি ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে৷ আবহাওয়া অধিদফতর থেকে প্রায়ই সমুদ্রে লঘু বা নিম্নচাপ ছাড়াই বায়ুচাপের তারতম্যের মাত্রা বেড়ে গেছে বলে জানানো হচ্ছে৷ হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় প্রায়ই বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেদের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমগুলোতে আসছে৷ কুতুবদিয়া, ভোলা, কক্সবাজারসহ বেশ কয়েকটি উপকূলীয় জেলায় সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ের কারণে ভাঙন তৈরি হচ্ছে৷ বেসরকারী সংস্থা অক্সফামের এক রির্পোটে বলা হয়েছে, ২০০৭-২০০৮ সালের বন্যায় দেশের নতুন নতুন এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে৷ বাঁধ ও এমব্যাংকমেন্টসহ বন্যা প্রতিরোধে তৈরি করা বিভিন্ন স্থাপনা পানির ঢল ঠেকাতে পারেনি৷
ফলে কৃষকের অর্ধেক বছরের খোরাকি ও বেঁচে থাকার অবলম্বন আমন ধানের উৎপাদন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বন্যা মোকাবেলার জন্য তৈরি করা অবকাঠামোগুলোর সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ হিমালয়ের বরফ গলে নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা৷
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ও শৈত্যপ্রবাহ
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রায় প্রতিবছরই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনুভূত হতো সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে৷ ১০ বছর ধরে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে৷ সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শৈত্যপ্রবাহ৷ বেড়ে গেছে তাপমাত্রাও৷ তাপপ্রবাহের বেড়ে যাবার কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে নগর ও গ্রামের জীবন৷ ২০০৭-০৮ সালে দেশে শৈত্যপ্রবাহের কারণে মারা গেছে শতাধিক মানুষ৷ মৃতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু৷ সবচেয়ে বেশি মারা গেছে উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোতে৷ সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো শীতার্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এলেও তা ভোগান্তি খুব সামান্যই কমাতে পেরেছে৷ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে যাওয়ার পাশাপাশি শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ এবং ঘনকুয়াশার স্থায়ীত্ব ও তীব্রতা বাড়ছে৷
আবহাওয়া অধিদফতরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর ০.০০৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বাড়ছে৷ ১০ বছর আগেও বেশিরভাগ সময় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অনুভূত হতো রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলায়৷ কিন্তু কয়েক বছর ধরে এই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে৷
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায়ই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠছে৷ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে৷ এ প্রবণতা সামনের দিনে আরো বাড়বে বলে বিশেজ্ঞদের আশঙ্কা৷
নিম্নচাপের হার বাড়ছে
গত ৪ বছর বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলে নিম্নচাপ ও লঘুচাপ বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়ছে৷ ফলে সমুদ্রবন্দরগুলোকে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় প্রতি মাসেই একাধিকবার ৩ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়৷ অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন বা লঘুচাপ ছাড়াও সমুদ্রে বায়ুচাপের তারতম্যের কারণে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে৷ প্রায়ই সাগর হয়ে উঠছে উত্তাল৷
অসময়ের তাপদাহ
সাধারণত বাংলাদেশে অক্টোবরের শুরু থেকে মাঝামাঝি যখন হালকা হিমেল হাওয়া বয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু গত বছরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে তখন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহ৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলেছে গরমের তীব্রতা৷
গরমের তীব্রতায় অনেকে জ্বর, সর্দি, কাশিসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন৷ শরতের এ সময়টাতে সাধারণত দেশের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে৷ অক্টোবরের মাঝামাঝি গিয়ে তাপমাত্রা আরো কমে ৩০ ডিগ্রির নিচে চলে যায়৷ অথচ এ সময় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে ৷ এ সময় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর রাজধানী ঢাকায় ছিল ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পাওয়া গেছে ময়মনসিংহে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে
দেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর জরিপ চালিয়ে দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো বলছে, দেশের উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে৷ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রতিবছর ভয়াবহ মাত্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বাঁধ ও বোল্ডার পর্যন্ত ভেঙে ফেলছে৷ ফলে প্লাবিত হয়ে পড়ছে বিপুলসংখ্যক কৃষিজমি ও বসতি৷ সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ১০০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে৷ সমুদ্র ভাঙনের কবলে পড়ে কুতুবদিয়ার ২৫০ ও সন্দ্বীপের ১৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে৷
প্রতিবেদক: সাগর সরওয়ার, সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক