জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মৎস উৎপাদন ঘাটতির মুখে বাংলাদেশ
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১মৎস অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর৷ বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর৷ সেই সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমার পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার৷
দেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ লোক জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৎসখাতের উপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে আবার ১২ লাখ মানুষ তাদের জীবন জীবিকার জন্য মৎসখাতের উপর নির্ভরশীল৷ বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ আমিষের চাহিদার ৬০ ভাগ আসে মাছ থেকে৷ দেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৬ শতাংশ ও জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ আসে মৎস খাত থেকে৷ গত ৫ বছরে এ খাতের আর্থিক গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ৷
নানাবিধ প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণে দেশের এই মৎস সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ হারিয়ে যাচ্ছে মাছের প্রজাতি৷ কমছে উৎপাদন৷ আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের গবেষণা মতে, বাংলাদেশের ৫৪ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের অবস্থা সংকটাপন্ন৷ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মৎস সম্পদের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ত্বরান্বিত হচ্ছে মৎস খাতের ক্রমাবনতি৷
জানা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে৷ গত দুই দশকে অনেকগুলো প্রজাতির মাছ পুরোপুরি হারিয়ে গেছে৷ ফলে এ অঞ্চলে মাছের আকালসহ উৎপাদনও দিনকে দিন কমছে৷ সিডর, আইলাসহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত এ এলাকায় এখন চিংড়ি চাষ ছাড়া দেশীয় প্রজাতির মাছের চাষ বিপর্যয়ের সম্মুখীন৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতুর চরিত্রে পরিবর্তন, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি — এসব ঘটতে থাকলে অচিরেই তা আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে বলেও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷ কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে যে অনিয়মগুলো দেখা যাচ্ছে, তা মাছের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেগুলো মোটেও ইতিবাচক নয়৷
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে খাল, বিল, প্লাবনভূমিতেও জুলাই মাস পর্যন্ত পানি না হওয়ার কারণে দেশীয় মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ এপ্রিল-মে মাস দেশীয় জাতের ছোট মাছের প্রজননকাল৷ যদিও এসব মাছ কয়েকবার ডিম ছাড়ে, কিন্তু ইতিমধ্যে এদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন সময়টা পেরিয়ে গেলে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই৷
অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের ক্রমবর্ধমান খরার সময় দীর্ঘতর হওয়ার কারণে পুকুর-ডোবা দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে৷ যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে মাছ চাষের জন্য জলাশয়ে পর্যাপ্ত পানি থাকছে না, পোনা মজুদের দুই-তিন মাস পরে মাছ বাজার আকৃতির হওয়ার আগেই পানি শুকিয়ে যাচ্ছে – যা মাছ চাষ, কৃষিসহ জীবন ও জীবিকার বিভিন্ন উত্পাদনমুখী সম্ভাবনাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ অসময়ে কুয়াশা, আকাশ মেঘলা থাকাও মাছ চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে চাষিরা মনে করেন৷
এবার এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস ইতিমধ্যে জমা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর জীবনব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য দুটি উপায় সামনে রয়েছে৷ এক, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে কাজে লাগাতে হবে৷ লবণাক্ততা সহনশীল চাষযোগ্য মাছের পোনা উত্পাদনের উদ্যোগ নিতে হবে যেমন — ভেটকি, বাটা ইত্যাদি৷ লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে এমন জলাশয়ে চিংড়ি, কাঁকড়া চাষের উদ্যোগ নিতে হবে৷ মনোসেক্স তেলাপিয়াও এ ক্ষেত্রে ভালো ফলন দেবে বলে তারা মনে করেন৷ দুই, খরা এলাকায় স্বল্প সময়ের পানিতে যদি বড় পোনা ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া যায়, এলাকায় বড় পোনা মজুদ রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তেলাপিয়া মাছ বেশ খরা সহনশীল৷
সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যাপ্রবণ এলাকায় মাছ চাষের চাহিদা অনুযায়ী পুকুরের পাড় উঁচু করে সমাজভিত্তিক মত্স্য পোনা ব্যাংক করা যায়, বন্যার আশঙ্কা নেই সে সময় ওই পোনা পুকুরে মজুদ করা যায়৷
প্রতিবেদন: সাগর সরওয়ার
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন