‘জলবায়ু ফান্ডের সঠিক ব্যবহার চাই আমরা’
১৫ আগস্ট ২০১৭ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের একটা অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে, আবার নতুন করে কিছু এলাকা জেগেও উঠতে পারে৷ আর এ সবের ফলে এখানে জলবায়ু শরণার্থী বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷'' আন্তর্জাতিক অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বা আইওএম-এর এই সাবেক কর্মকর্তা ও জলবায়ু বিশ্লেষকের কথায়, ‘‘আমাদের দেশে যেটা হয়, সুশাসনের অভাবে দেশীয় ফান্ড বা আন্তর্জাতিক যে ফান্ড আছে, তার সদ্ব্যবহার সব সময় ঠিকমতো হয় না৷ বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণ ফান্ড আসছে৷ তার যেন ঠিকমতো ব্যবহার হয়, সেটাই চাই আমরা৷''
ডয়চে ভেলে: জলবায়ু শরণার্থী বলে একটা কথা প্রচলিত আছে৷ এর উদ্ভব কবে থেকে?
আসিফ মুনির: আসলে গত ১০-১৫ বছর ধরে, বিশেষ করে যখন থেকে জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে, তখন থেকেই জলবায়ু শরণার্থী নামটি চলে আসছে৷ অনেক সময় দেশের মধ্যেই মানুষকে তাঁর স্থান পরিবর্তন করতে হয়৷ প্রাকৃতিক কারণে বা ভাঙনের কারণে প্রতিনিয়তই মানুষ তাঁর বাড়ি-ঘর হারাচ্ছে৷ এটা কিছুটা মনুষ্য সৃষ্ট৷ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বৈশ্বিক৷ এর প্রভাব সবখানেই পড়ছে৷ এ সব কারণে গত ১০-১৫ বছরে এই টার্মটা একটু বেশি ব্যবহার হচ্ছে৷
বাংলাদেশে কি জলবায়ু শরণার্থী আছে? থাকলে এঁরা আসলে কারা?
এখনও সরাসরি বলা হচ্ছে না যে, বাংলাদেশে জলবায়ু শরণার্থী রয়েছে৷ কারণ জলবায়ুর কারণে যে প্রভাব পড়ছে, আমরা বাংলাদেশে সেটা চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি না৷ নদী ভাঙন হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে, ঝড় হচ্ছে বা সাইক্লোন হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে, তা সরাসরি বলা যাচ্ছে না৷ তবে এটা বলা হচ্ছে যে, আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরে বাংলাদেশের বড় একটা অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে৷ হয়ত নতুন কিছু জায়গা জেগে উঠবে৷ এই যে বিলীন হয়ে যাবে, সেটা হবে জলবায়ুর প্রভাবের কারণে৷
জলবায়ুর কারণে শরণার্থী যাঁরা হচ্ছেন, তাঁরা কি যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন?
বাংলাদেশে যেহেতু সরাসরি জলবায়ু শরণার্থী বলা যাচ্ছে না, তাই ক্ষতিপূরণের চেয়ে আমাদের প্রধান দরকার পূর্বপ্রস্তুতি৷ এর জন্য আন্তর্জাতিক ফান্ড রয়েছে, বাংলাদেশের জন্যও যার মধ্যে বরাদ্দ রয়েছে৷ আমাদের দেশে যেটা হয়, সুশাসনের অভাবে দেশীয় ফান্ড বা আন্তর্জাতিক যে ফান্ড আছে তার সদ্ব্যবহার সব সময় ঠিকমতো হয় না৷ মানুষের সাহায্যের ক্ষেত্রে যে কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো সব সময় প্রস্তুত থাকে না৷ বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণ ফান্ড আসছে৷ তার যেন ঠিকমতো ব্যবহার হয়, সেটাই চাই আমরা৷
বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে অনেকেই নদীর ভাঙন কিংবা যে কোনো ভাবে হোক ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার কারণে ঢাকায় আসেন৷ এরা কী শরণার্থী হিসেবে পরিচিতি পাবেন?
পুরোপুরি না, এক্ষেত্রে আমরা বলছি অভ্যন্তরীণ অভিবাসন৷ তবে ভবিষ্যতে তাঁরা শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যেতে পারেন৷ আমরা যদি সঠিক ভাবে তাঁদের সহায়তা করতে না পারি৷ তবে এটা ঠিক যে, অনেক এলাকার মানুষ প্রকৃতির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজের এলাকায় থাকতে পারছেন না৷ বাস্তবতা যে তাঁরা শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন৷ এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে যে উদ্যোগগুলো নেয়া দরকার, যেমন নদীর ভাঙন ঠেকানো হোক বা বাঁধ নির্মাণ হোক, এই কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে৷ পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে যে, জীবন রক্ষার প্রয়োজনে যদি তাঁদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয় তাহলে যেতে হবে৷
রোহিঙ্গারাও শরণার্থী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে৷ এটা কেন?
শরণার্থীকে যদি আমরা সংজ্ঞা হিসেবে ধরি, তাহলে মূলত যাঁদের নিজের দেশে জীবন বিপন্ন হচ্ছে, এই কারণে তাঁরা অন্য একটি দেশে আশ্রয় নিচ্ছেন – তাঁরাই কিন্তু শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন৷ এই হিসেবে তাঁরা অবশ্যই শরণার্থী৷ কারণ মিয়ানমারে তাঁদের বাড়ি-ঘর ছিল, জমি ছিল৷ এ সব ফেলে তাঁরা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছেন৷ তাঁদের অনেককে সেখানে প্রাণে মেরে ফেলা হচ্ছে, জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক ভাষ্য অনুযায়ী তাঁরা আমাদের দেশে প্রকৃত শরণার্থী৷
মানুষ তো মানুষই, সে কেন শরণার্থী হবে?
এটি আসলে রূঢ় বাস্তবতা৷ মানুষ হিসেবে মানুষকে যে সম্মান দেখানো দরকার, যে সহায়তা করা দরকার, আমরা অনেক সময় সেটা করতে পারি না৷ কারো অবস্থা ভালো থাকে, কারো অবস্থা খারাপ থাকে৷ মিয়ানমার থেকে যাঁরা আমাদের দেশে এসেছেন, তাঁদের তো সেখানে বাড়িঘর ছিল৷ বংশপরম্পরায় তাঁরা সেখানে বাস করেছেন৷ কিন্তু তাঁদের উপর নির্যাতন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যার কারণে তাঁরা দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন৷ প্রকৃতির কারণেই হোক বা মানুষের কারণেই হোক সারা বিশ্বে শরণার্থী কমে আসবে তেমনটাই আমরা প্রত্যাশা করব৷
শরণার্থী বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে কী ধরনের ভূমিকা পালন করে?
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মূলত মানবিক সহায়তার দিকটি নিশ্চিত করে থাকেন৷ আর শরণার্থীরা যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত হয়, তাহলে ইউএনএইচসিআর রয়েছে: তাঁরা আরো কিছু সহায়তা দিয়ে থাকেন৷ খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি বাসস্থানের ন্যূনতম ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কাজটি তাঁরা করেন৷ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বা এনজিও অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার ব্যবস্থাও করে থাকে৷
মানুষকে শরণার্থী বলার ক্ষেত্রে নীতিমালায় কোনো বাধা আছে কি?
মানুষকে শরণার্থী বলার ক্ষেত্রে নীতিমালায় কোনো বাধা নেই৷ শরণার্থীরা যে দেশে আশ্রয় নেন, সেই দেশের আইন অনুযায়ী বা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাঁদের একটা ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়৷ যেমন ধরুন সিরিয়ার শরণার্থীরা যখন বাইরে গিয়ে আশ্রয় নেন, তাঁদের সুবিধার্থেই তাঁদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ এর জন্য আলাদা নীতিমালার প্রয়োজন নেই৷ কারণ আন্তর্জাতিক একটা নীতিমালা বা কনভেনশন তো আছেই৷
শরণার্থী বলার মাধ্যমে আমরা কি তাঁদের মানুষ হিসেবে অবহেলা করছি না?
শরণার্থী বললে বরং কিছু সুবিধা আছে৷ কারণ যে মানুষগুলোকে শরণার্থী বলা হচ্ছে, তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু সহায়তা করা সম্ভব হয়৷ তাঁরা অবশ্যই প্রথমত মানুষ৷ মানুষ হিসেবে তাঁদের কিছু অধিকার থাকে৷ শরণার্থী হয়ে পড়ার পর তাঁদের মানুষ হিসেবে যে অধিকার বা মানবাধিকার, সেটা কিন্তু অনেক সময় বিঘ্নিত হয়৷ ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করাটা তাঁদের জন্যই বেশি জরুরি৷ কারণ তাঁদের কিছু বেশি সুবিধা নিশ্চিত করাটা তখন সম্ভব হয়৷ তবে অবশ্যই তাঁরা প্রথমত মানুষ৷
জলবায়ুর প্রভাবের কারণে বাংলাদেশে তো ভবিষ্যতে জলবায়ু শরণার্থী বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে৷ এক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী হবে?
সরকার আন্তর্জাতিকভাবে এটা নিয়ে অনেক সক্রিয়৷ বিদেশে যখন এটা নিয়ে কোনো সম্মেলন হয়, তখন সরকারি প্রতিনিধি তো থাকেই৷ অনেক বেসরকারি প্রতিনিধিও সেখানে অংশ নেন৷ আমরা জানি এই বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে অনেক বেশি টানাপোড়েন থাকে, রাজনৈতিক দেনদরবার থাকে, সেখানে আমাদের সরকারের অনেক বেশি সক্রিয় থাকতে হবে৷ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়টা জরুরি৷ কারণ আমরা জানি না এটা কখন কীভাবে আঘাত হানবে৷ তবে ধীরে ধীরে যে এর প্রভাব বাড়তে থাকবে, সেটা তো আমরা জানিই৷ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে এটা থাকতে হবে৷ প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ সহ সব ধরনের প্রস্তুতি সরকারি বা বেসরকারি ভাবেও নেয়া যেতে পারে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷