জাতিসংঘের গাইডলাইনে হাসিনার আমলের গুমের তদন্ত ও বিচার দাবি
৩০ আগস্ট ২০২৪আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এইসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করা, যাতে এর স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড মেনে চলা নিশ্চিত করা যায়৷
তারা বলেছে, বাংলাদেশে গুরুতর নির্যাতনের তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একটি প্রস্তাব চাওয়া উচিত৷ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছে লেখা এক চিঠিতে এ কথা বলেছে মানবাধিকার সংস্থাটি৷
তাদের কথা, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) থেকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং কাউন্সিলে প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত৷ ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৭তম অধিবেশন শুরু হবে৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি)-র নির্দেশিত তদন্ত বাংলাদেশিদের কাছে সর্বাধিক স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে৷
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও মানবাধিকার কর্মীরাও মনে করেন এসব অপরাধের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হওয়া দরকার৷ জাতিসংঘের সহায়তা নেয়া অপরিহার্য বলেও মনে করেন তারা৷
সরকার এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের' ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছে৷ আর গুম থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষায় গুম ও নির্যাতন বিষয়ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ৷ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স সনদে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷
শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত জোরপূর্বক গুমের ৭০০টিরও বেশি ঘটনা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার৷
এইচআরডাব্লিউ মনে করে, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেসামরিক তদারকি আনা, কুখ্যাত ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ব়্যাব) ভেঙে দেয়া, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং অবমাননাকর আইন সংশোধন করার পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা৷''
মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, ‘‘শেখ হাসিনার পতনের আগে বিক্ষোভ দমন-পীড়ন ছিল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী৷ ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে কমপক্ষে ৪৪০ জন নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছেন, যার বেশিরভাগই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র ও যুব সংগঠনের সহিংসতার কারণে নিহত ও আহত হয়েছেন৷ ৫ আগস্টের পর আনুমানিক আরো ২৫০ জন মারা গেছে, যাদের বেশিরভাগই সহিংস প্রতিশোধের শিকার৷''
‘গুমের' ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আমরা গুম, বিচার বহির্ভুত হত্যা ও নির্যাতনের ব্যাপারে সব সময়ই আন্তর্জাতিক তদন্ত ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার দাবি করে আসছি৷ আমরা মনে হয়, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এর তদন্ত হওয়াই ভালো৷ এর বিচার ও তদন্তে মানবাধিকারের বিষয়ও দেখতে হবে৷''
‘‘জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল এখন ঢাকায় কাজ করছে৷ তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশ ও সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের হাতে হত্যার তদন্তে সহায়তা করছে৷ হাসিনা সরকারের সময় গুম ও ক্রসফায়ারের তদন্তেও একইভাবে সহায়তা নেয়া যায়৷ বিচার বাংলাদেশেই হবে৷ আমরা জাতিসংঘের গাইডলাইন মেনে করবো,'' বলেন তিনি৷
তার কথা, ‘‘আর প্রযুক্তিগত সহায়তাও নিতে হবে৷ অনেক ঘটনা আছে, যার তথ্য প্রমাণ স্যাটেলাইট ইমেজ ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে৷ আয়নাঘরের মতো বিষয়ও তদন্তের আওতায় আনতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আগে বলা হতো, আমাদের আইনে গুম বিষয়টিই নেই৷ আর সামরিক বাহিনী থেকে ব়্যাবে এসে যারা এইসব অপরাধে জড়িয়ে পড়তেন, তাদের সামারিক বাহিনীতে ফেরত পাঠিয়ে রক্ষা করা হতো৷ তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে৷ ব়্যাবের মতো প্রতিষ্ঠান রাখার দরকার নাই৷ কারণ, এখানে যারা আছেন, তারা গুলি করতেই অভ্যস্ত৷ জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তায় পুলিশকে আরো প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক করা যায়৷''
‘‘গুমের ঘটনা তদন্তে যেহেতু সরকার কমিশন গঠন করেছে৷ আর গুম ও নির্যাতন বিষয়ক কনভেনশনে এই সরকার যেহেতু স্বাক্ষর করেছে, ফলে গুমের তদন্ত ও বিচার বিশ্বমানের হবে বলে আশা করছি,'' বলেন তিনি৷
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট কাওসার আহমেদ বলেন, ‘‘গুমের তদন্ত ও বিচার জাতিসংঘের সহায়তার করলে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে৷ আর এখানে আমাদের সক্ষমতার প্রশ্নও আছে৷ জাতিসংঘের তো সক্ষমতা আছে৷ তাদের সহায়তা নিয়ে সেই সক্ষমতা আমরা কাজে লাগাতে পারি৷''
তার কথা, ‘‘আমরা গুম বিষয়ক রোম কনভেনশনে মাত্র স্বাক্ষর করেছি৷ এটাকে বলে অ্যাকসেশন৷ ৩০ দিন পর এটা বাংলাদেশের ওপর বাধ্যকর হবে৷ তখন ওই কনভেনশনের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশকে আইন করতে হবে৷ গুমের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে কনভেনশন অনুযায়ী৷ আর যে একটি কমিশন হয়েছে, তাদেরও সেই কনভেনশন মেনে কাজ করতে হবে৷ এটা অবশ্যই অগ্রগতি৷ তবে আমাদের সক্ষমতা অর্জন কনতে হবে৷ তাই এখন জাতিসংঘের সহায়তা নেয়াই ভালো৷''
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা সব সময়ই গুম, ক্রসফায়ারের মতো অপরাধ নিয়ে কাজ করেছি৷ আমাদের কাছে ১০০ গুমের তদন্ত প্রতিবেদন আছে৷ তবে আমরা ফৌজদারি তদন্ত করতে পারি না৷ আইনে সীমবদ্ধতা আছে৷ আমরা সব সময়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়েকে তদন্তের জন্য চিঠি দিয়েছি৷''
‘‘জাতিসংঘ যদি গুম, ক্রসফায়ারের তদন্ত করতে চায়, আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি,'' বলেন তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত যত গুমের অভিযোগ এবং তথ্য আমাদের কাছে এসেছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছি৷ ২৫ আগস্টের মধ্যে আমরা প্রতিবেদন চেয়েছিলাম, কিন্তু এখনো পাইনি৷''