জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের কেন এই দশা?
২০ অক্টোবর ২০১৬অপেক্ষাকৃত নবীন নেতা নেহেরু-গান্ধী পরিবারের উত্তরসূরি রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রস পার্টি এখন এক ঐতিহাসিক সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে৷ ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভরাডুবির পর এখনো পর্যন্ত পায়ের নীচে মাটি নেই৷ ২০০৯ সালের নির্বাচনে ৫৪৩টি সংসদীয় আসনের মধ্যে কংগ্রেস জোটের যেখানে ছিল ২৬২টি আসন, বর্তমানে তা এসে ঠেকেছে মাত্র ৪৪টিতে৷ রাজ্য বিধানসভার ভোটেও একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কংগ্রেসের৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত এত বড় একটা ঐতিহ্যমন্ডিত পার্টি, যাকে বলা হতো সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বা পাওয়ার-হাউস, আজ কংগ্রেসের হাল দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, কেন এই দৈন্যদশা?
পাওয়ার হাউস হিসেবে যাঁরা একদা কংগ্রেসের হাল ধরে রেখেছিলেন, সেইসব ওজনদার নেতারাও কংগ্রেসকে ডুবন্ত জাহাজ মনে করে একে একে মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন৷ যেমন, চৌধুরি বীরেন্দ্র সিং, রাও ইন্দরজিত সিং এবং হালে উত্তরপ্রদেশের সাবেক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রীতা বহুগুনাও কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ এখন দলের যিনি মূল কান্ডারি, সেই সোনিয়া গান্ধীও যেন আজ উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে আছেন৷ গান্ধী পরিবারের ধারাবহিকতা বজায় রাখতে. তিনি বুঝতে চেষ্টা করেননি, পরিবারতন্ত্র চিরকাল চলে না৷ এটা ষাট বা সত্তরের দশক নয়৷
দলের সাংগঠনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি৷ আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে ৭টি বড় রাজ্যে নির্বাচন৷ সবথেকে আগে উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাব৷ সেইভাবেই দলীয় দায়দায়িত্বের নতুন বিন্যাস জরুরি৷ বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের রোগ নিরাময়ের সক্রিয় উদ্যোগ নেননি, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল৷ ফলে এক সময়ে যে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ছিল কংগ্রেসের দুর্গ, আজ সেই রাজ্যে কংগ্রেসের অস্তিত্বই মুছে গেছে৷ তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস কখনো ক্ষমতায় আসেনি, আসার সম্ভাবনাও নেই৷ হরিয়ানা কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়েছে গত নির্বাচনে৷ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে কংগ্রেসের মৌরসিপাট্টা দীর্ঘকালের৷ সেই রাজ্যও কংগ্রেসের হাতছাড়া৷
এটা দিনের আলোর মতো সত্য যে, রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কংগ্রেসের জন্য এক বোঝা৷ তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি বা বিচক্ষণতার যথেষ্ট অভাব আছে৷ এমনটাই মনে করেন পর্যবেক্ষক মহল৷ সাংসদ হিসেবে বিতর্কে অংশ নেওয়া বা দলের হয়ে জোরালো বক্তব্য রাখা কিংবা সংসদে তাঁর নিয়মিত উপস্থিতি নিয়েও ঘরে বাইরে তিনি সমালোচিত৷ আসামের বিদ্রোহী কংগ্রেস নেতা হেমন্ত বিশওয়া শর্মা তো বলেই বসলেন, রাহুল গান্ধী অনিচ্ছুক রাজনীতিক৷ তাঁকে জোর করে রাজনীতিতে টেনে আনা হয়েছে৷গান্ধী পরিবারের প্ল্যাকার্ড তুলে ধরতে৷ কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেবার জন্য যে নিষ্ঠার দরকার, সেটা তাঁরমধ্যে নেই৷
ক্যাডার-ভিত্তিক দলে পরিবারতন্ত্র অচল৷
এই প্রসঙ্গেই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বললেন প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ডক্টর অমল মুখোপাধ্যায়৷ তিনি মনে করেন, কংগ্রেসের মধ্যে এখন চলেছে নেতৃত্বের সংকট৷রাজীব গান্ধীর সময় পর্যন্ত যে ধরণের নেতৃত্ব ছিল আজ কংগ্রেসের মধ্যে তা নেই৷ দ্বিতীয়ত, রাজ্য স্তরে কংগ্রেসের সাগঠনিক কাঠামো খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ সেই কারণে কংগ্রেস শক্তি হারাচ্ছে৷ রাজ্যগুলিতে দলের সাংগঠন খুবই আগোছালো৷ অধিকাংশ রাজ্যেই কংগ্রেসের উপযুক্ত নেতার অভাব৷ এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে রাহুল গান্ধী কতটা সফল হবেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷ এক কালে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের যে ক্যারিশমা ছিল, রাহুল গান্ধীর মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই৷ আম জনতাকে আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতা নেই রাহুল গান্ধীর৷
ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দল থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে বসানো৷ বিগত ২০০৪ আর ২০০৯ সালে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পেছনে ছিল প্রণববাবুর সাগঠনিক দেখভাল এবং কলাকৌশল৷ তাঁরই হওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী৷ তাঁকে রাষ্ট্রপতি করায় কংগ্রেসের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক বলতে কিছুই রইলো না৷ প্রণববাবু যদি থাকতেন, তাহলে সম্ভবত কংগ্রেসকে গত নির্বাচনে এই রকম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতো না৷''
ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ভোট আসন্ন৷ জাতীয় রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশ চিরকালই দিক নির্দেশক৷ কাজেই সেই নির্বাচনের ফলাফল হবে রাহুল গান্ধীর জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা৷ যদিও এক মিডিয়া চ্যানেলের প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষায় ইতিমধ্যেই এক পূর্বাভাষে কংগ্রেসকে চতুর্থ স্থানে বসানো হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে রাহুল গান্ধীর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে৷