জাপানের পথে প্রধানমন্ত্রী, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা
২৫ এপ্রিল ২০২৩মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫৬ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ভিভিআইপি চাটার্ড ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা৷
সোমবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘‘দুই প্রধানমন্ত্রীর (বাংলাদেশ ও জাপান) উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে আটটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে৷''
সফরকালে কৃষি, মেট্রোরেল, শিল্প উন্নয়ন, জাহাজ রিসাইক্লিং, শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়, মেধাস্বত্ব, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, আইসিটি ও সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে জানান তিনি৷
বুধবার জাপানের সম্রাট নারুহিতোর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ একই দিন তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো জানান, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নৈশভোজের মাধ্যমে বৈঠকটি শেষ হবে৷ জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসী বাংলাদেশীদের আয়োজিত সংবর্ধনা ও একটি বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন৷
প্রধানমন্ত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য চার জাপানি নাগরিককে ‘ফ্রেন্ড অব লিবারেশন ওয়ার অনার' তুলে দেবেন৷
বৃহস্পতিবার টোকিওতে বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
টোকিও সফরকালে প্রধানমন্ত্রী জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশির সঙ্গে বৈঠক করবেন৷ এছাড়াও তিনি জাইকা, জেইটিআরও, জেইইআইসি, জেবিপিএফএল, জেবিসিসিইসি'র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকসহ আরও কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দিবেন৷
ত্রিদেশীয় সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা৷
প্রধানমন্ত্রী টোকিও থেকে ১ মে ওয়াশিংটন ডিসিতে পৌঁছেবেন৷ যোগ দেবেন বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ৫০ বছরের অংশীদারিত্ব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে৷ ৪ মে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য কমনওয়েলথ দেশের রাজা ও রাণী হিসেবে তৃতীয় চার্লস এবং তার পত্নী ক্যামিলার রাজ্যাভিষেকে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের উদ্দেশে ওয়াশিংটন ত্যাগ করবেন৷ আগামী ৯ মে লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা পৌঁছবেন বলে আশা করা যাচ্ছে৷
এদিকে ত্রিদেশীয় সফরের আগেরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫-দফা ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিও) প্রকাশ করা হয়৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশের আইপিও পড়ে শোনান৷
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘বৈশ্বিক জিডিপিতে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার সম্মিলিত অংশীদারিত্ব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রাধিকার, অধিকতর জলবায়ু কর্মসূচি এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত গতিশীলতা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিস্থাপকতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হতে পারে৷''
‘‘বৈশ্বিক জিডিপিতে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার সম্মিলিত অংশীদারিত্ব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রাধিকার, অধিকতর জলবায়ু কর্মসূচি এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত গতিশীলতা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিস্থাপকতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হতে পারে৷''
আইপিওটি ১৫-দফা উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে৷ এতে চারটি নির্দেশক নীতি অনুসরণ করা হয়েছে যার প্রথমটি হলো (ক) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির বাণী ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়'৷
বাকি তিনটি নির্দেশক নীতি হলো-
(খ) জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি, সেইসাথে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদে উল্লিখিত নীতিগুলির প্রতি শ্রদ্ধা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির প্রয়োগ না করার জন্য এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা৷
(গ) ১৯৮২ সালের ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য সি (ইউএনক্লস)-সহ প্রযোজ্য সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘের চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো মেনে চলা৷
(ঘ) টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবিক পদক্ষেপ এবং মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা৷
আইপিও অনুসারে, উপরে উল্লিখিত নীতিগুলির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যগুলো বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সম্পৃক্ততাকে পরিচালনা করবে:
১. পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধা জোরদার করা, অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং ইন্দো-প্যাসিফিকের সকলের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংলাপ ও বোঝাপড়ার জোরদার করা৷
২. ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিদ্যমান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যার মধ্যে সমুদ্রে জরুরী পরিস্থিতিতে সাড়া প্রদান এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধার পরিচালনা করা এবং আন্তর্জাতিক আইন এবং ইউএনক্লস ১৯৮২সহ প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী নেভিগেশন ও ওভার-ফ্লাইটের স্বাধীনতার অনুশীলনকে সমুন্নত রাখা৷
৩. ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অংশীদারদেরসহ আন্তর্জাতিক অস্ত্রবিস্তার রোধ, শান্তিরক্ষা, শান্তি বিনির্মাণ এবং সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টায় অর্থবহ ও ফলপ্রসূ অবদান বজায় রাখা৷
৪. আদর্শিক ও ব্যবহারিক উভয় পদক্ষেপের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা৷
৫. একটি ‘শান্তির সংস্কৃতি'র ফ্ল্যাগশিপ এজেন্ডায় বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব প্রসারিত করা, ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা' এজেন্ডায় গুরুত্ব বাড়ানো, আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি জোরদার করা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করা৷
৬. উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়ম-ভিত্তিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা জোরদার করা যা ইন্দো-প্যাসিফিক এবং এর বাইরেও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নের অধিকার এবং সবার জন্য অভিন্ন সমৃদ্ধির মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়ন লাভে সক্ষম করে তুলবে৷
৭. ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি, ডিজিটাল এবং মানব সংযোগ উন্নত করা, পণ্য, পরিষেবা, পুঁজি ও পদ্ধতিগতভাবে মানুষের চলাচলের সুবিধা দান এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর, উদ্ভাবন ব্যবহারের সুযোগ লাভ, এবং উন্মুক্ত ও নিরাপদ সাইবারস্পেস এবং মহাকাশে বাইরে দায়িত্বশীল আচরণ জোরদার করা৷
৮. ভবিষ্যৎ সঙ্কট ও বিঘœগুলোকে আরও ভালভাবে মোকাবেলা করা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ বাণিজ্য প্রবাহকে উন্নীত করার জন্য স্থিতিস্থাপক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খল তৈরির জন্য দেশীয় কৃষি, উৎপাদন এবং পরিষেবা খাতগুলোকে কাজে লাগানো৷
৯. এসডিজি-১৪ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিগুলোর অনুসরণে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মহাসাগর, সাগর, এবং সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ, টেকসই ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনা জোরদার করা৷
১০. ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, পানি সংহতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের প্রয়াস জোরদারে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকা, যার মধ্যে স্বদেশের ভাল অনুশীলনগুলোর বিনিময় করা৷
১১. প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রতিশ্রুতিগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, সামুদ্রিক দূষণ এবং পরিবেশের উপর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ও ক্ষতিকারক প্রভাবগুলির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বাস্তবসম্মত কাজ চালিয়ে যাওয়া৷
১২. নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সহ সকলের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা৷
১৩. ভবিষ্যত মহামারী মেকাবেলায় সমন্বিত সাড়াদান ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করা এবং ভ্যাকসিন, ডায়াগনস্টিকস ও অন্যান্য চিকিৎসার মতো বৈশ্বিক জনসাধারণের পণ্যগুলোতে সকলের অধিকারসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা৷
১৪. আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার এবং পারস্পরিক কল্যাণজনক পরিপূরক ব্যবস্থা জোরদারের জন্য উপ-আঞ্চলিক অংশীদার ও প্রাসঙ্গিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা৷
১৫. ‘স্মার্ট বাংলাদেশ' রূপকল্পের সাথে সঙ্গতি রেখে সকলের অভিন্ন কল্যাণের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে সহযোগিতা জোরদার করা৷
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বেশির ভাগ বড় শক্তি, যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে তাদের নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে৷
জেকে/কেএম (বাসস)