জার্মান নির্বাচন ২০১৩
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৩নির্বাচনি প্রচারের মজাই হলো এই যে, সেখানে রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু বাস্তব রাজনীতি বলতে কিছু করা হয় না৷ নির্বাচনের আগে সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শিকেয় তোলা থাকে৷ কিন্তু নির্বাচন শেষ হলেই সেগুলো আবার মাথাচাড়া দেয়, অন্তত গলাখাঁকারি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়৷
ধরা যাক ইউরো সংকট৷ সেটা যে আপাতত খানিকটা বিশ্রাম নিচ্ছে, নির্বাচনের পরেই আবার গণমাধ্যমের শীর্ষক জুড়ে বসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ ইউরোপের কয়েকটি সংকট পীড়িত দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে নিরাময়ের দিকে না হলেও, অন্তত উপশমের দিকে৷ তবে গ্রিস সম্ভবত একা তার ব্যাধি সামাল দিতে পারবে না: দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ হল ত্রিশ হাজার কোটি ইউরো৷
জার্মান অর্থমন্ত্রী ভল্ফগাং শয়েবলে-কে কিছুদিন আগেও বলতে শোনা গেছে: ‘‘গ্রিসের জন্য আরো একটি ত্রাণ কর্মসূচি লাগবে৷ সেটা জার্মান সংসদেও একাধিকবার বলা হয়েছে৷'' ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিকে বছর শেষ হবার আগেই সেই নতুন ত্রাণ কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ কাজেই সেটা নতুন জার্মান সরকারের প্রথম মাথাব্যথাগুলির মধ্যে পড়বে৷
বাজেট ঘাটতি
অর্থনীতির ক্ষেত্রে অধিকাংশ ইইউ দেশের চেয়ে জার্মানির অবস্থা ভালো: উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, রফতানি ভালোই চলেছে; সেই সঙ্গে কর থেকে সরকারি আমদানিও তুঙ্গে চড়েছে৷ তা সত্ত্বেও জার্মানির সরকারি ঋণ ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ইউরোর বেশি, এবং বছরের পর বছর সরকারের আমদানির চেয়ে সরকারি ব্যয় বেশি৷ একাধিক প্রদেশ কিংবা রাজ্যও বিপুলভাবে ঋণগ্রস্ত৷ বহু নগর ও পৌর কর্তৃপক্ষ বস্তুত দেউলিয়া৷ প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চায়৷
কিন্তু সেটা হবে কী ভাবে? ব্যয়সংকোচ করে, নাকি কর বৃদ্ধি করে? এসপিডি এবং সবুজরা ঘোষণা করেছে, তারা অন্তত যাদের আয় বেশি, এমন মানুষদের কাছ থেকে আরো বেশি কর দাবি করবে৷ সিডিইউ এবং এফডিপি তার সম্পূর্ণ বিরোধী৷ যুগপৎ প্রায় সব দলই তাদের পেটোয়া পরিকল্পনা-প্রকল্পগুলোর জন্য দরাজ হাতে ব্যয় করতে চায়৷ সিডিইউ চায় আগের প্রজন্মের মায়েদের জন্য বর্ধিত অবসর ভাতা; এসপিডি এবং সবুজরা চায় শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও একেবারে কচিকাঁচাদের জন্য নার্সারিতে জায়গা বাড়াতে, যাতে এ প্রজন্মের মায়েরা কাজে যেতে পারেন৷ ওদিকে জার্মানিকে ২০২০ সালের মধ্যে ব্যালান্সড বাজেটের ব্যবস্থা করতে হবে৷
সামাজিক ন্যায়
নির্বাচনের পরেও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটি তার গুরুত্ব হারাবে না৷ প্রথমেই আসবে শিক্ষাক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ: প্রতিটি শিশু যাতে জীবনে একই সুযোগ পায়, যে সমানাধিকারের সূচনাই বিদ্যায়তন থেকে৷ কিন্তু জার্মানিতে আজ একটি শিক্ষিত পরিবারের শিশুর স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করার যে সম্ভাবনা, কোনো অল্পশিক্ষার পরিবারের শিশুর সে সম্ভাবনা অনেক কম৷
স্ত্রী-পুরুষের, পূর্ব-পশ্চিমের একই বেতন; একই কাজের জন্য একই মজদুরি বা পারিশ্রমিক, সেই সঙ্গে ন্যূনতম মজদুরির প্রশ্নগুলি নির্বাচনের আগেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, নির্বাচনের পরেও গুরুত্বপূর্ণ থাকবে৷ জার্মান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও অনেক জার্মানের চোখে অন্যায়, কেননা তাতে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমার সদস্যরা নানা ধরনের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন৷ এছাড়া দেশের জনসংখ্যাগত বিকাশের প্রশ্নটাও থাকছে: ক্রমেই আরো কমসংখ্যক নবীনদের আরো বেশি সংখ্যক প্রবীণদের চিকিৎসার খরচ টানতে হবে৷
জ্বালানি ও অন্যান্য সমস্যা
বছর দুয়েক আগে জার্মানি জ্বালানি ক্ষেত্রে ‘‘মোড় ফেরানোর'' সিদ্ধান্ত নেয়৷ সে যাবৎ জার্মানির মোট বিদ্যুৎ খরচের ২৩ শতাংশ আসে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং বায়োগ্যাস থেকে৷ ২০১৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অনুপাতকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে৷ কিন্তু সমস্যা হল ট্রান্সমিশন বা ওভারহেড তারের মাধ্যমে উপকূল থেকে দেশের অভ্যন্তরে, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিদ্যুতের পরিবহন নিয়ে৷
দ্বিতীয়ত, জ্বালানি ক্ষেত্রে এই ‘‘অয়নের'' খরচের একাংশ আসছে বিদ্যুতের দামের উপর একটি সারচার্জ চাপিয়ে৷ এবং যতো বেশি নবায়নযোগ্য, পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ সৃষ্টি হবে, ততোই এই সারচার্জের পরিমাণ বাড়বে৷ এছাড়া বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান এই সারচার্জ দেওয়া থেকে ছাড় পেয়ে থাকে, যা সকলের মনঃপূত নয়৷
সবশেষে আসছে সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে জার্মানিতে আশ্রয় দেবার প্রশ্ন৷ এ ক্ষেত্রে জার্মান সরকার ইতিমধ্যেই পাঁচ হাজার সিরীয় উদ্বাস্তুকে লেবানন থেকে জার্মানিতে নিয়ে আসা শুরু করেছেন, কিন্তু জার্মানির আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়, বলে অনেকে মনে করেন৷