জার্মান প্রেস কোড ও মাথাব্যথা
২৮ জুন ২০১৬১৯৫২ সালে ফেডারাল সরকার একটি প্রেস অ্যাক্ট বা সংবাদমাধ্যম আইনের খসড়া পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৫৬ সালে নিরপেক্ষ জার্মান প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয়৷ সাধারণ জনতা পত্র-পত্রিকায় দোষত্রুটি দেখলে প্রেস কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ করতে পারেন৷
জার্মান প্রেস কাউন্সিলের ১৯৭৩ সালে প্রণীত ১৫ পাতার প্রেস কোডটি সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়৷ মুখবন্ধে এই প্রেস কোডের ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘‘গাইডলাইনস ফর জার্নালিস্টিক ওয়ার্ক'' বা ‘সাংবাদিকতার নীতিমালা' হিসেবে৷ সেই সঙ্গে রয়েছে ‘‘অভিযোগ দাখিল করার পদ্ধতি''৷ প্রেস কাউন্সিলের কাছে নাকি বছরে প্রায় ৭০০ অভিযোগ ও তত্ত্বতালাস আসে, যার ৫০ ভাগের সহজেই উত্তর দেওয়া যায়৷
প্রেস কোডের মূল গাইডলাইনগুলিতে নির্বাচনি প্রচার অভিযানের উপর কিভাবে রিপোর্টিং করতে হবে, প্রেস রিলিজে কি থাকা উচিত, জনমত সমীক্ষার ফলাফল কিভাবে প্রকাশ করতে হবে, ইত্যাদি বিষয় তো বটেই – এমনকি প্রতীকী ছবি বা পাঠকদের চিঠি-পত্রের ভালোমন্দ, সব বিষয়েই মোটামুটি একটা ধাঁচা বেঁধে দেবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে৷ ভ্রম সংশোধন বা তথ্যের গোপনীয়তা, এ সব বিষয়ও স্বভাবতই বাদ যায়নি৷ বিজ্ঞাপনের জগৎও ঢুকে পড়েছে, যেমন এসেছে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে৷ বলতে কি, সাংবাদিকতা ও সংবাদ প্রকাশনার কাজে যতো ধরনের নীতিবিদ্যাগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার সব ক'টির ক্ষেত্রে কোনো না কোনো নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রেস কোডে৷
কোলনের সেই রাত
তা সত্ত্বেও এমন সব পরিস্থিতি দেখা দেয়, যেখানে কোনো নীতিমালা যে খাটে অথবা খাটে না,তা বলা শক্ত৷ এমন একটি ঘটনা ছিল নববর্ষের প্রাক্কালে কোলন শহরের মুখ্য রেলওয়ে স্টেশনের সামনের চত্বরে মহিলাদের উপর হামলা৷ যারা হামলা চালিয়েছে,তাদের মধ্যে বেশ কিছু ব্যক্তিকে দেখে উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত বলে মনে হয়েছে – একাধিক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী এ খবর দেওয়া সত্ত্বেও মিডিয়া খবরটি প্রচার করেনি৷
এ নিয়ে জার্মান প্রেস কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ এলে পর প্রেস কাউন্সিল ঘটনার প্রায় দু'মাস পরে রায় দেয় যে, সম্ভাব্য অপরাধীদের ধর্ম বা জাতিগত খবরাখবর প্রকাশ করলে বৈষম্যমূলক আচরণের সৃষ্টি হতে পারে, কাজেই প্রেস কোডে কোনোরকম রদবদল করা হবে না৷ প্রেস কাউন্সিলের পক্ষে এ কথা বলা সহজ, কিন্তু পেগিডা-র মতো ইসলাম-বিরোধী আন্দোলন স্বভাবতই তা মেনে নেয়নি এবং পূর্বাপর জার্মান মিডিয়াকে ‘‘ল্যুগেনপ্রেসে'' বা মিথ্যাচারী সংবামাধ্যম বলে অভিহিত করে চলেছে৷
অপরদিকে ‘‘জেক্সিশে সাইটুং''-এর মতো সংবাদপত্র ঘোষণা করেছে যে, তারা ভবিষ্যতে জার্মান বা বহিরাগত নির্বিশেষে অপরাধীদের জাতি-ধর্ম প্রকাশ করবে, কেননা জরিপে দেখা গেছে যে, এ জাতীয় কোনো খবর না দিলে পাঠকরা ধরে নেন যে, অপরাধী অ-জার্মান বিদেশি-বহিরাগত হতে বাধ্য৷
ব্যোমারমান ও এর্দোয়ান
জার্মানির ৪০ শতাংশ মানুষ যখন এমনিতেই মিডিয়ার সত্যবাদিতা নিয়ে দ্বিধা পোষণ করতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই – গত মার্চ মাসের শেষাশেষি – বিস্ফোরিত হয় তথাকথিত ব্যোমারমান কেলেংকারি৷ জার্মান টেলিভিশনে এক জার্মান সঞ্চালক তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে জঘন্যতম গালাগাল দিয়ে লেখা একটি বিদ্রুপাত্মক লেখা পড়ে শোনান – স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গ হিসেবে৷ ওদিকে জার্মানি তখন উদ্বাস্তুর স্রোত আটকাতে ঠিক সেই এর্দোয়ানের উপরেই নির্ভরশীল৷ এছাড়া জার্মান আইন অনুযায়ী বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের অপমান করা আবার দণ্ডনীয় অপরাধ৷
মামলা চলেছে, কিন্তু আরো বড় প্রশ্ন হল, জার্মানিতে ব্যঙ্গের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতারই বা কি হবে? আর রাষ্ট্রের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে জার্মান প্রেস কাউন্সিল বা জার্মান প্রেস কোডই বা পরিস্থিতি কতটা সামলে উঠতে পারবে?
ক্রমশ প্রকাশ্য...৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷