সাফল্য পেলেন আল-সিসি
৪ জুন ২০১৫মিশরে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষ রাজনৈতিক কারণে বন্দি অবস্থায় রয়েছেন৷ ঢালাওভাবে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হচ্ছে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত দুই বছরে এমন ৭৪০টিরও বেশি রায় নথিভুক্ত করেছে, যেগুলি আইনি ত্রুটিতে ভরা৷ শুধু কট্টর ইসলামপন্থিরাই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যন্ত্রের কুনজরে পড়ছে না, উদারপন্থি মানবাধিকার কর্মী ও গণতন্ত্রের পক্ষে লড়ছেন, এমন অ্যাক্টিভিস্টরাও বাদ পড়ছেন না৷ এই সব মানুষগুলি ইউরোপ থেকে সহায়তার আশা করেন এবং সেটাই তাঁদের প্রাপ্য হওয়া উচিত৷
সে কারণেই আমি মনে করি, এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মিশরের একচ্ছত্র শাসক আবদেল ফাতাহ আল-সিসিকে জার্মানিতে এমন বিশাল আন্তর্জাতিক মঞ্চ ও কূটনৈতিক মর্যাদা দেওয়া মোটেই ঠিক হয়নি৷ তাঁকে কোনো অপ্রিয় প্রশ্নেরও জবাব দিতে হয় নি৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মানবাধিকারের বিষয়টি উত্থাপন এবং মৃত্যুদণ্ডের সমালোচনা করেছেন বটে, কিন্তু এমন ঢালাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তুলনায় সেই সমালোচনার সুর ছিল বড়ই নরম৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেলকে প্রশ্ন করা উচিত, তিনি কেন আল-সিসিকে এত তাড়াতাড়ি বার্লিনে আমন্ত্রণ জানালেন৷
ভুল বার্তা
আঙ্গেলা ম্যার্কেল নিজে এক সময়ে মিশরে সংসদ নির্বাচনকে আল-সিসির সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বশর্ত হিসেবে তুলে ধরেছিলেন৷ সেই নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না৷বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তা অবাধ ও মুক্ত হতে পারবে না৷ আল-সিসি ডিক্রি জারি করে শাসন করছেন এবং কড়া হাতে দেশের মানুষের একটা বড় অংশকে দমন করে চলেছেন৷ রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্রের প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম সেই কাজে সহায়তা করছে৷ তারা আরও ঘনঘন পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতা করছে বা সেখানকার নানা চক্রান্তের তত্ত্ব খাড়া করছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল এই বিষয়টি নিয়েও কোনো কড়া কথা শোনাননি – অন্তত প্রকাশ্যে নয়৷ কায়রোয় জার্মানির কনরাড আডেনাউয়ার ফাউন্ডেশনের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অমূলক অভিযোগের ভিত্তিতে কারাদণ্ডের রায়ের বিষয়টি ম্যার্কেল উত্থাপন করেছেন বটে, আরও দৃঢ় কণ্ঠে সেই অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি করা উচিত ছিল তাঁর৷ এমন নরম মনোভাবের ফলে আল সিসি হয়তো আরও উৎসাহ পাবেন৷
আল-সিসি কি সত্যি স্থিতিশীলতার প্রতীক?
মিশর অবশ্যই এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র৷ জার্মানি ও ইউরোপ মিশরকে উপেক্ষা করতে পারে না৷ অন্যান্য শক্তিশালী স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য – যেমন রাশিয়া, চীন বা সৌদি আরব৷ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ভূমধ্যসাগরে শরণার্থী সংকট বা গোটা অঞ্চল জুড়ে নানা সংকটের সমাধানের ক্ষেত্রে কায়রোকে সত্যি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু একই সঙ্গে ইউরোপকে ভালো করে বুঝতে হবে, মিশর বর্তমানে কতটা সহায়ক ভূমিকা রাখছে৷
আমার মতে, মিশর ঠিক এর বিপরীতটাই করছে৷ আল-সিসির অভ্যন্তরীণ নীতি মোটেই টিউনিশিয়ার মতো সামাজিক মেলবন্ধনের লক্ষ্যে চালিত হচ্ছে না, বরং বিভিন্ন শিবিরের মধ্যে আরও মেরুকরণ ঘটিয়ে উত্তেজনার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলছে৷ মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে কড়া দমন নীতি সন্ত্রাসী শক্তিগুলির প্রচারণায় ইন্ধন যোগাচ্ছে৷ লিবিয়ায় আল-সিসি এমন রাজনৈতিক শক্তিকে মদদ দিচ্ছেন, যারা ঠিক তাঁর মতোই নরম ইসলামপন্থিদের অংশগ্রহণে বৃহত্তর সামাজিক সংলাপের বিরুদ্ধে লাগাতার কাজ করে চলেছে৷ মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে এমন নিপীড়নের ফলে মিশরকে আর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে না, কারণ হামাস মুসলিম ব্রাদারহুডেরই অংশ৷ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় এভাবে অবদান রাখা যায় না বলেই আমি মনে করি৷
আল-সিসিকে আদৌ আমন্ত্রণ না জানানো অথবা সেই আমন্ত্রণ বিলম্ব করার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ ছিল৷ তিনি যদি সত্যি সংস্কারের বিশ্বাসযোগ্য অ্যাজেন্ডা পেশ করতে পারতেন অথবা কমপক্ষে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতেন, তখন এমন আমন্ত্রণ ন্যায্য হতো৷ আর কিছু না হোক, অর্থনৈতিক কারণে আল-সিসি জার্মানির উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল৷ কিন্তু জার্মানির মানবাধিকার সংগঠনগুলি ও বিরোধী দলগুলির দাবি সত্ত্বেও আল-সিসির উপর চাপ সৃষ্টি করার সেই সম্ভাবনা মোটেই কাজে লাগানো হচ্ছে না৷ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কী রকম সমালোচনা হয়েছে, তা জানার উপায় নেই৷ আল-সিসি কিন্তু তাঁর জার্মানি সফরকে প্রচারণার ক্ষেত্রে সাফল্য হিসেবেই তুলে ধরতে পারছেন৷
গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি আনুগত্য?
একটি মানুষ কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রমাণ দিয়েছেন৷ তিনি হলেন জার্মান সংসদের নিম্ন কক্ষ বুন্ডেসটাগ-এর স্পিকার নরবার্ট লামার্ট৷ তিনি ম্যার্কেলের দল সিডিইউ-র নেতাও৷ তিনি মিশরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনার কারণে আল-সিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করেছেন৷ অন্যদিকে আবার ম্যার্কেলের দলের আরেক নেতা – ফল্কার কাউডার মিশরের এক টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে সংলাপে সে দেশের একনায়কের এমন ভূয়সী প্রশংসা করেছেন – মানবাধিকারের বিষয়টি যেন তাঁর নিজের বা নিজের দলের জন্য মোটেই কোনো ভূমিকা রাখে না৷ বুঝতেই পারছেন, মিশরের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে কার কণ্ঠ ফলাও করে প্রচার করা হবে, আর কারটা হবে না৷