জার্মানি থেকে দক্ষিণ এশিয়া: স্বাস্থ্যের দায় কার?
গুগল খুলে ইউরোপ বা জার্মানিতে চিকিৎসকদের ধর্মঘট নিয়ে খোঁজ করলেই দেখা যাবে যে এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। ছবিঘরে দেখুন সেই কথা৷
ইউরোপজুড়ে একই চিত্র
গত প্রায় দুই দশক ধরে জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ যেমন ফ্রান্স, পোল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়াম ও যুক্তরাজ্য, সর্বত্র অধিকার আদায়ের দাবিতে পথে স্বাস্থ্যকর্মীরা।
পথে নামছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা
ইউরোপের চিকিৎসকেরা যতবারই রাজপথে নেমেছেন, দাবি প্রতিবারই ছিল স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধি, টানা লম্বা সময় ধরে একনাগাড়ে কাজ করায় বিরতি আনা ও অবিলম্বে নতুন, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিযুক্তি। সাথে ছিল চিকিৎসকদের মাইনে বাড়ানোর কথাও। অন্যান্য পেশায় কর্মরত ব্যক্তিদের তুলনায় চিকিৎসকদের আয় বেশি হলেও, পরিসংখ্যান বলছে সময়ের সাথে সাথে খরচ বাড়লেও, মাইনে বাড়েনি। কিন্তু বেড়েছে কাজ, কাজের সময়, কাজের চাপ।
জার্মানিতে যেমন
২০২৩ সালে জার্মানির প্রায় সব রাজ্যে ধর্মঘটে নামেন চিকিৎসকেরা। এর আগে ২০২২ সালে বার্লিনের শারিটে হাসপাতালের কর্মীরা ধর্মঘটে নামেন।
চিকিৎসকের অভাব
জার্মানিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলি মেটানো রাষ্ট্রের কর্তব্য। তবে সেটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। কিন্তু খোলা বাজারে আটকে থাকাটা জার্মানির জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এখানে চিকিৎসা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও ডাক্তারের দেখা পাওয়ার কোনো ঠিক নেই। কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, যেমন শল্য চিকিৎসক বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতেই বছর ঘুরে যাবার প্রবল সম্ভাবনা।
অভাবের কারণ জনসংখ্যা
জার্মানির জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশের বয়েস ৬৫'র ওপরে। অন্যদিকে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়েসি জার্মানদের সংখ্যা এখন যা, ততোটা কম এর আগে কখনো হয়নি। চলতি দশকের শেষে, জার্মানিতে অবসরপ্রাপ্ত বাসিন্দার সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে একলাফে দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে, বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে একদিকে যেমন কমবে করদাতার সংখ্যা, অন্যদিকে বাড়বে রাষ্ট্রের ওপর স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবার চাপ।
কেমন জার্মান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা?
ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানি। এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুটি বিপরীতধর্মী দিকের কথা। প্রথম, এখানে স্বাস্থ্য বীমা বাধ্যতামূলক, এবং তার মাসিক মূল্য ভাগাভাগি করে নেয় যারা বীমাধারী ও আমাদের নিয়োগকর্তা ব্যক্তি বা সংস্থা। যারা স্বনির্ভর, তাদের পুরোটাই নিজেদের দিতে হয়, আবার যাদের সামর্থ্য নেই এই খরচ দেবার, তাদের স্বাস্থ্যবীমার ভার সরকারের। সেই টাকার বড় অংশ আসে জনতার দেওয়া কর থেকে।
দক্ষিণ এশিয়ার সাথে পার্থক্য
ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে তারুণ্যের জোয়ার অবারিত থাকলেও সেই তারুণ্যকে পুরোপুরি প্রশিক্ষিত মানবসম্পদে পরিণত করা যায়নি। সাথে, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক পেশাকে সন্দেহের নজরে দেখা, এটাও আমাদের গভীরে প্রোথিত। দেশে কান পাতলেই শোনা যায়, "রোগী বেঁচে গেছে? ভগবানের অশেষ কৃপা! রোগী বাঁচেনি? নিশ্চয়ই ডাক্তার ভালো না!" এই মানসিকতা থেকে তাই ডাক্তার বা অন্য কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক পেশার প্রতি সম্মান তৈরি হয়ন৷
কীভাবে মোকাবিলা করবে জার্মানি?
জার্মানির সমস্যা মোকাবিলা করতে পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন দেশের অভিবাসন নীতির, যা ইতিমধ্যে কিছুটা শুরুও হয়ে গেছে। গোটা দুনিয়ার প্রশিক্ষিত তরুণ চিকিৎসকরা জার্মানি না এসে পাড়ি দেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশে, যেখানে ভাষা জানা নিয়ে অত কড়াকড়ি নেই। কোন বিষয় প্রাধান্য পাবে, স্বাস্থ্য না ভাষা, সেই তর্কে না গিয়ে জার্মানির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার সমাধান অসম্ভব।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাধান...
দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা মেটাতে প্রয়োজন স্বাস্থ্যখাত কী, অন্তত সেই মৌলিক আলোচনায় ফিরে গিয়ে ঠিক করা, যে এই খাত আসলে কার লাভের জন্য? মানুষের না বাজারের? প্রশ্ন করতে হবে, রোগী মারা গেলে এই দায় কি একা ডাক্তারের? না কি প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু আসলে আমাদের অবিজ্ঞানমনস্ক বাজারমুখী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দিকে উঁচিয়ে থাকা এক একটা আঙুল?