জার্মানিতে অনার কিলিং
১১ আগস্ট ২০১১পরিবারের সদস্যরাই হত্যা করল নিজ পরিবারের কাউকে৷ বলা হচ্ছে, পরিবারের সম্মান বাঁচাতে হত্যা করা হচ্ছে একান্ত আপনজনকে৷ ভুক্তভোগী হয়ত পরিবারের চোখে ‘অনৈতিক' কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, যা পরিবারের বা সমাজের অন্য সদস্যদের জন্য অপমানজনক, তাই হত্যা করা৷ এমন হত্যাকাণ্ডকেই বলা হচ্ছে ‘অনার কিলিং'৷ অধিকাংশক্ষেত্রে মেয়েরা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও, পুরুষরাও বাদ যাচ্ছে না৷
জার্মানিতে ‘অনার কিলিং' বিষয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছে মাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট৷ এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার আলোকে জার্মান সাম্পাহিক ‘ডেয়ার স্পিগেল' জানাচ্ছে, জার্মানিতে ‘অনার কিলিং'-এ অংশ নিচ্ছে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা৷ তবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের হার বাড়েনি৷ আবার একেবারে কমও নয়৷
২০০৯ সালে মার্চ মাসে ২০ বছর বয়সি তরুণী গুলসুম এস. কে হত্যা করে তার বাবা এবং ভাই৷ নিজের বাবা-ভাই গুলসুম এর মাথায় এতটাই আঘাত করেছিল যে, তার চেহারা শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ কুর্দি বংশোদ্ভূত এই তরুণীকে জার্মানিতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল, কেননা সে পরিবারের চোখে ‘অনৈতিক' উপায়ে কুমারীত্ব হারায়৷ তার গর্ভপাত করতে হয়েছিল, যা ছিল কুর্দি পরিবারটির জন্য অসম্মানজনক৷
২০০৫ সালে ভাইয়ের হাতে প্রাণ হারায় আরেক তরুণী, হাতুন সুরুচু৷ গুলি করে তাকে হত্যা করেছিল তারই আপন ভাই৷ মাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সংগঠিত এরকম ৭৮টি ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেছে৷ এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ১০৯ জন৷ প্রকাশিতব্য ২৫০ পাতার এই গবেষণায় ‘অনার কিলিং'-এর ভয়াবহত তুলে ধরা হয়েছে৷ যেমন, ২২ বছর বয়সি এক কুর্দি তরুণ তার ছোট বোনকে ৪৬ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে৷ বোনটির অপরাধ, সে তার স্বামীকে ত্যাগ করেছিল৷ একইভাবে জর্ডানের এক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে হত্যা করে তার পরিবার, কেননা কিশোরী তার পরিবারের পছন্দসই ছেলেবন্ধুকে গ্রহণ করেনি৷
তবে এ সব গবেষণায় একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, জার্মানিতে ‘অনার কিলিং'-এর হার বাড়ছে না৷ কয়েকবছরের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বছর ভেদে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়৷ যেমন, ১৯৯৮ সালে জার্মানিতে ‘অনার কিলিং'-এর ঘটনা ছিল দু'টি৷ ২০০৪ সালে আবার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১২টি৷ দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতিবছর সাত থেকে ১০টি ‘অনার কিলিং' হচ্ছে জার্মানিতে৷
‘ডেয়ার স্পিগেল'-এ প্রকাশিত গবেষণার সারসংক্ষেপে দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে, পিতৃশাসিত পরিবারের নারীরা অবাধ্য হলে বা পরিবারের নিয়মকানুন না মানলে বিপদে পড়ছে৷ এসব নারীর পুরুষ সঙ্গী নির্বাচনের বিষয়টি পারিবারিক একটি ইস্যু হিসেবে গণ্য হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে যদি নারীটি প্রতিবাদ করে, তবে তা পরিবারের জন্য অসম্মানজনক হিসেবে গণ্য করা হয়৷
মাক্স প্ল্যাঙ্ক-এর গবেষণায় চার ধরনের ‘অনার কিলিং'-এর সন্ধান পাওয়া গেছে:
- ভুক্তভোগী ‘আইনসংগত' সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাচ্ছিল কিংবা সরে এসেছে৷ গবেষকরা ৪৩টি এরকম ঘটনা পেয়েছেন৷
- ভুক্তভোগী ‘আইনসংগত নয়' এমন সম্পর্কে অংশ নিয়েছিল৷ অর্থ হচ্ছে ভুক্তভোগী বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক অংশ নেয় এবং গর্ভধারণ করে৷ কিংবা পরিবারের চোখে ‘ভুল' কোনো পুরুষ সঙ্গী বেছে নিয়েছিল৷ ৭৮টি ঘটনার মধ্যে ২৫টি'র কারণ এটি৷
- ভুক্তভোগী স্বাধীন জীবনযাপনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল৷ মানে পশ্চিমা জীবনযাপনে আগ্রহী হয়েছিল কিংবা পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী বিবাহে সম্মত হয়নি৷ ২০টি হত্যাকাণ্ডের কারণ এটি৷
- ধর্ষিতাকে হত্যার ঘটনা৷ দেখা গেছে, কোনো তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা তার পরিবারের জন্য অসম্মানজনক৷ গবেষকরা এরকম আটটি ঘটনা পেয়েছেন৷
গবেষণার বিস্ময়কর দিক হচ্ছে, ভুক্তভাগী সবাই কিন্তু নারী নন৷ ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪৩.১ শতাংশ পুরুষ৷ তবে, অনেকক্ষেত্রে পুরুষরা হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না৷ বরং যে নারীকে হত্যা করা হয়েছে, তার পুরুষ সঙ্গীকেও হত্যা করা হয়েছে একইভাবে৷ ‘অনার কিলিং'-এর শিকার অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে৷ ভুক্তভোগীদের মধ্যে শুধুমাত্র সাত শতাংশের বয়স ৩০ বছরের বেশি৷
‘অনার কিলিং'-এ অংশে নেওয়া হামলাকারীদের বয়স অবশ্য বেশি৷ ৩২ শতাংশের বয়স চল্লিশের উপরে৷ ৭৮ ঘটনায় অভিযুক্ত ১২২ হামলাকারীর মধ্যে ৭৬ জনই তুর্কি বংশোদ্ভূত৷ এছাড়া বিভিন্ন আরব দেশ এবং সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বংশোদ্ভূতরাও জার্মানিতে ‘অনার কিলিং'-এ অংশ নিচ্ছে৷
শেষ করার আগে, ৫ আগস্টের একটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যাক৷ বার্লিনে প্রকাশ্যে গুলি করে দুই মহিলাকে হত্যা করে এক যুবক৷ হত্যাকারীর অবশ্য লক্ষ্য ছিল তারই সাবেক স্ত্রী৷ তবে প্রাণে বেঁচে যায় সেই নারী৷ বরং প্রাণ হারায় তার মা এবং বোন৷ এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক৷ ধারণা করা হচ্ছে, এটিও একটি ‘অনার কিলিং'৷