জার্মানিতে অবসরের বয়স ৭০ করা নিয়ে বিতর্ক
২৯ আগস্ট ২০২২বিপদের আলামত অবশ্য ইতিমধ্যে বেশ দেখা যাচ্ছে৷ প্রতি বছরই অবসর নিচ্ছেন অনেকে৷ কিন্তু নতুন নিয়োগ সেই অনুপাতে হচ্ছে না৷ ফলে বাড়ছে শূন্য পদ৷ এ বছরের প্রথম চার মাসে মোট শূন্য পদের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে৷ জানা গেছে, গত এপ্রিল শেষে জার্মানিতে মোট শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার৷ জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের পর এই প্রথম সংখ্যাটা এই পর্যায়ে গেল৷
পাশাপাশি বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা আর কমছে তরুণের সংখ্যা৷ কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে জার্মানির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ ভাগের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২৪ বছর৷ অথচ ৬৫ বা তার বেশি বয়সির ছিল ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের দ্বিগুণ, অর্থাৎ ২০%৷
এভাবে একদিকে শূন্য পদ ক্রমশ বেড়ে চলা এবং বিপরীতে তরুণের সংখ্যা সেই অনুপাতে না বাড়ায় পেনশন সিস্টেমের ওপর চাপ বাড়ছে৷ আর তাই উঠেছে অবসরে যাওয়ার বয়স ৭০ বছর করে এক ঢিলে দুই পাখি মারা, অর্থাৎ, শূন্য পদ এবং পেনশন ব্যবস্থার ওপর চাপ কমানোর প্রস্তাব৷
সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রস্তাব প্রথম শোনা গেছে জার্মানির মেটাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ- এর কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি স্টেফান ভোল্ফ-এর কণ্ঠে৷ চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স ৭০ করার পক্ষে যুক্তি দেখান৷ জার্মানিতে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ করার প্রস্তাব আগে থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে৷ যাদের জন্ম ১৯৬৭ সালের পরে, তাদের ৬৭ বছর পর্যন্ত চাকরিতে রাখার সিদ্ধান্ত পর্যায়ক্রমে চালু করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরুও হয়েছে৷ তবে অবসরের বয়স ৭০ করার পক্ষে এখনো দৃশ্যত বেশি মানুষ নেই৷ তাই স্টেফান ভোল্ফের প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন জার্মানির ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা৷ বাম দলের নেতা ডিটমার বার্ট্শ মনে করেন অবসরের বয়স ৭০ করার প্রস্তাব স্রেফ ‘সমাজবিরোধী আবর্জনা'৷
পেনশন ব্যবস্থায় চাপ বাড়বে কেন?
জার্মানির পেনশন সিস্টেম অনুযায়ী, চাকুরিজীবীরা প্রতি মাসে নিজেদের বেতনের ৯% বয়স্কভাতা খাতে জমা দেন৷ সরকারের পক্ষে থেকেও দেয়া হয় সমপরিমান, অর্থাৎ আরো ৯%৷ এই টাকাটা খরচ যারা কর্মজীবন শেষ করে ইতিমধ্যে অবসর ভাতায় জীবনযাপন শুরু করা মানুষদের পেছনে৷
যেহেতু তরুণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে না, অথচ চাকরি ক্ষেত্রে শূন্য পদ বাড়ছে, তাই অবসরে যারা গিয়েছেন, তাদের প্রাপ্য ভাতা দেয়া ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ছে৷
তো পেনশন ব্যবস্থায় এমন সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কায় কিন্তু এবারই প্রথম পড়েনি জার্মানি৷ ১৯৮০-র দশকেও অর্থনীতিবিদরা সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন৷ কিন্তু সরকার তখন বিষয়টিকে তেমন আমলে নেয়নি৷ তখনকার শ্রম মন্ত্রী নর্বার্ট ব্ল্যুম অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কার জবাবে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের পেনশন ব্যবস্থা খুব নিরাপদ৷''
১৯৮৬ সালে শ্রম মন্ত্রী ছিলেন সিডিইউ নেতা৷ এখন এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন সামাজিক গণতন্ত্রী (এসপিডি) দলের হুবার্টুস হাইল৷ তবে দল ভিন্ন হলেও পেনশন ব্যবস্থার বিষয়ে দুজনের অবস্থানই আপাতত এক৷ তাই জার্মানির বর্তমান শ্রমমন্ত্রীও অবসরের বয়স ৭০ করা ঠিক হবে কিনা- এই বিতর্ককে উড়িয়ে দিয়েছেন ‘ফ্যান্টম বিতর্ক' বলে৷
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এভাবে বেশিদিন তরুণদের সংখ্যা কমতে থাকার পাশাপাশি চাকরিতে শূন্যপদ বাড়ার দ্বিমুখী সমস্যাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না৷
মিউনিখ সেন্টার ফর দ্য ইকোনমিক্স অব এজিং-এর ইয়োহানেস রাউশ মনে করেন, ‘‘অবসরের বয়স বাড়ানো সবসময়ই খুব অজনপ্রিয় একটি ভাবনা৷ এ কারণেই ভাবনাটিকে রাজনীতিবিদরা খারিজ করে দেন৷'' কিন্তু ডেনমার্ক, ইতালি এবং এস্তোনিয়ায় ইতিমধ্যে তরুণ কমে যাওয়া এবং শূন্য পদ বাড়তে থাকায় অবসরের বয়স বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করছে৷
জার্মানির অর্থনীতি গবেষণা ইন্সটিটিউট-এর উপ-প্রধান ইয়োহানেস গেয়ার মনে করেন, ইউরোপের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশটিতেও অবসরের বয়স বাড়ানো উচিত৷ তার মতে, অবসরের বয়স বাড়ালে সমস্যা হবে, তবে তাতে কোনো বিপর্যয় নেমে আসবে না৷ বরং সাময়িক ধাক্কা সামলে নেবে কয়েক বছরের মধ্যে৷
পেনশন ব্যবস্থায় সম্ভাব্য সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন যে হচ্ছে তার খরচ কে কতটা বহন করবে, তা একেবারেই বিতরণবিষয়ক প্রশ্ন৷ অবসরের বয়স বাড়ালে কর্মজীবী মানুষদের ওপর তার একটা চাপ অবশ্যই পড়বে৷ বিশেষ করে যাদের বেশিদিন বাঁচার সম্ভাবনা কম এবং যাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আছে, চাপটা তাদের ওপরই বেশি পড়বে৷ জনসংখ্যার বেশ উল্লেখযোগ্য একটা অংশ তো অবসর জীবন শুরুর আগেই মারা যান৷''
গেয়ার অবশ্য শুধু অবসরের বয়স বাড়ানোকেই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় মনে করেন না৷ এর বাইরেও দুটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন তিনি, এক, অভিবাসনকে উৎসাহিত করা, দুই, যারা ‘মিনিজব' করছেন, তাদের ধীরে ধীরে পূর্ণ সময়ের কাজের সুযোগ দেয়া৷ তার ভাষায়, ‘‘আমাদের অভিবাসন দরকার৷ জার্মানিতে কাজ করার মতো লোকের সংখ্যা বাড়াতে বাইরে থেকে লোক আনা খুব দরকার৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের দেশে অনেক মানুষই মিনিজব করেন৷ তারা খুব কম বেতনে কম কাজ করেন৷ ফলে তারা করের আওতায় আসেন না, সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আর্থিক অবদানও খুব একটা রাখেন না৷ তাদের নিয়মিত কাজে নিয়োজিত করলে সুফল পাওয়া যাবে৷''
হেলেন হুইটল, লিসা হ্যানেল/ এসিবি