জার্মানিতে আফগান শরণার্থীদের প্রতিবাদ
২৪ জানুয়ারি ২০১৮মঙ্গলবার জার্মানির ড্যুসেলডর্ফ বিমানবন্দরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিল ১১ বছর বয়সি আফগান কিশোরী হাদিসা বখশে৷ ‘‘আফগানিস্তানে যুদ্ধ আর প্রচুর বোমাবাজি, বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন৷ সেখানে কাউকে ফেরত পাঠানো উচিত নয়,'' বলে হাদিসা৷
গত এক বছরে প্রত্যাখ্যাত আফগানদের মোট নয়টি দলকে বিমানযোগে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হলো৷ এমন বহিষ্কারের বিরুদ্ধে জার্মান সুশীল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ‘আফগান চিৎকার' নাম দিয়ে একটি উদ্যোগ নিয়েছেন, যার ফলশ্রুতি হিসেবে দু'শ' থেকে তিন'শ' মানুষ মঙ্গলবার ড্যুসেলডর্ফ বিমানবন্দরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন – হাদিসাও তাদের মধ্যে ছিল৷
২০১৬ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে ১৫৫ জন আফগানকে জার্মানি থেকে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ ‘ডিপোর্টেশন'-এর বিরোধীরা এ ধরণের বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘণের ঘটনা হিসেবে গণ্য করেন, কেননা তালেবান ও ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সংঘটিত একটানা সহিংসতার ফলে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনো সঙ্গীণ৷ শুধুমাত্র গত সপ্তাহান্তেই কাবুলের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উপর সন্ত্রাসি আক্রমণে ৩০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আফগানিস্তানে উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠানোর যুক্তি হিসেবে যেসব ‘নিরাপদ এলাকার' কথা বলেছেন, সে ধরণের কোনো নিরাপদ এলাকা আফগানিস্তানে নেই বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিমত৷
আফগানিস্তান নিরাপদ নয়
হাদিসার পরিবার গত দু'বছর ধরে জার্মানিতে রয়েছে৷ হাদিসার মা মরিয়ম জানালেন যে, তিনি ড্যুসেলডর্ফ বিমানবন্দরে প্রতিবাদ প্রদর্শন করতে এসেছেন, ‘‘যাতে মানুষজন দেখতে পারেন যে, আফগানিস্তান কোনো নিরাপদ জায়গা নয়৷'' এছাড়া তিনি চান না যে, তাঁকে অথবা তাঁর তিন সন্তানকে আফগানিস্তানের মতো একটি বিপজ্জনক স্থানে বাস করতে হবে – সে আশঙ্কাও তাঁর আছে৷ ‘‘কাল বেঁচে থাকবে কিনা, সেটা ওখানে কেউ জানে না,'' বললেন মরিয়ম৷ আপাতত তাঁর পরিবারকে জার্মানিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷
ড্যুসেলডর্ফ বিমানবন্দরের প্রতিবাদে হাজির আর এক আফগান বিক্ষোভকারী সংযত কণ্ঠেই বললেন, ‘‘কাল বা পরশু এমন একটা রাত্রি আসবে যে, আমাকে আফগানিস্তানে ফেরত যেতে হবে, সেটাই আমার ভয়... ভয়ে আমি ঘুমোতে পারি না৷''
নবম দলগত প্রত্যাবর্তনের আগে মিডিয়ায় ৮০ জন আফগানকে কাবুলে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হলেও, শেষমেষ ১৯ জন উদ্বাস্তু চার্টার বিমানটিতে আসনগ্রহণ করেন – তাদের মধ্যে কয়েকজন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী৷
আদালতের রায়, আপিলের শুনানি অথবা স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে অতীতে বহু ডিপোর্টেশন স্থগিত রাখতে হয়েছে৷ অন্যন্য অনেক সম্ভাব্য ‘ডিপোর্টি' তাদের ডিপোর্টেশনের নির্দেশ কার্যকর হবার আগেই উধাও হয়েছেন – অর্থাৎ তাদের বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
আরেকটি নতুন সমস্যা দৃশ্যত নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়ে৷ জার্মান পুলিশ ইউনিয়নের এক মুখপাত্র একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, প্রস্তাবিত ডিপোর্টেশনগুলি কার্যকর করার মতো লোকবল ফেডারাল পুলিশের নেই৷ যেমন, ড্যুসেলডর্ফ থেকে কাবুল উড়ালের জন্য এবার গোড়ায় পুলিশকর্মীদের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক ভলান্টিয়ার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷
নানা রাজ্যে নানা শর্ত
কাদের বহিষ্কার (অর্থাৎ স্বদেশে ফেরত পাঠানো) যাবে না, তার ওপর ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বিধিনিষেধ রয়েছে – প্রধানত মহিলা ও শিশুদের ক্ষেত্রে৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে তিনটি গোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গের বহিষ্কৃত হবার সম্ভাবনা বেশি: অপরাধী; জনজীবনের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য ব্যক্তিরা; এবং যারা আত্মগোপন করে রয়েছেন অথবা ভুয়া পরিচয় দিয়েছেন৷ কিন্তু উদ্বাস্তু সাহায্য সংস্থাগুলির বক্তব্য হলো যে, জার্মানির প্রতিটি রাজ্যে এই সব মাপকাঠি আলাদা আলাদাভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে৷
একদিকে যেমন জার্মান সমাজে ভালোভাবে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কারের একাধিক ঘটনা ঘটেছে, অন্যদিকে তেমন জনতার বিরোধিতায় সে ধরনের ব্যক্তিদের বহিষ্কার একাধিকবার রুখে গিয়েছে৷
‘‘সব আফগান সন্ত্রাসবাদের শিকার,'' বলেন হাসামুদ্দিন আনসারি৷ তিনি একটি হুইলচেয়ারে বসে বিক্ষোভ সমাবেশে এসেছেন৷ আনসারি হেরাতের কাছে একটি বোমা আক্রমণে দু' পা হারান তিনি৷ তিনি জার্মানিতে তিন বছর ধরে আছেন এবং উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন৷ আনসারি সগর্বে জানালেন যে, তিনি তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ করছেন৷
১১ বছর বয়সের হাদিসাও স্কুলে যাচ্ছে৷ ‘‘আমরা পালিয়ে জার্মানিতে আসি, যাতে আমি স্কুলে যেতে পারি,'' জানাল হাদিসা৷ সে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে৷ বড় হয়ে হাদিসা ডাক্তার হতে চায়৷
বহিষ্কৃতদের নিয়ে বিমানটি কাবুল যাত্রা করার পর বিক্ষোভকারীরা যখন নিজেদের বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন, তখন একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘‘এটাই শেষ (ডিপোর্টেশন) নয়৷''
রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ব্যর্থ হওয়া ফলে বা অন্যান্য কারণে ১৪,০০০-এর বেশি আফগান উদ্বাস্তুকে জার্মানি থেকে দেশে ফিতে হবে বলে জার্মানির অভিবাসন দপ্তর জানিয়েছে৷ তবে তার মধ্যে হাজার দশেক উদ্বাস্তুকে আপাতত জার্মানিতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, কেননা, নিকট ভবিষ্যতে তাঁদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করানো সম্ভব নয়৷
আন্ড্রেয়া গ্রুনাউ/এসি