জার্মানিতে ইসলাম স্বীকৃতি পাবার পথে কতদূর?
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭জার্মানির ‘গ্রুন্ডগেজেট্স' বা ‘বুনিয়াদি আইন'-এর চার নম্বর সূত্র বলছে, ‘‘ধর্মের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা এবং নিজের ধর্মীয় বা দার্শনিক বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকার অলঙ্ঘনীয়৷''
অবাধ ধর্মাচরণের স্বাধীনতারও গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে৷ সংবিধানের তিন নম্বর সূত্র অনুযায়ী ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মীয় মতামতের কারণে কারো বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না৷
সংবিধানে গ্যারান্টিকৃত অন্যান্য বুনিয়াদি অধিকারের মতোই ধর্মীয় স্বাধীনতার সীমা হলো, যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা মানবমর্যাদা বা অপরের বুনিয়াদি অধিকার লঙ্ঘন করে; অথবা যখন মুক্ত গণতন্ত্রের হানি ঘটানোর জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতার অপব্যবহার করা হয়৷
ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, ঐ সম্প্রদায়কে ‘পাবলিক ল কর্পোরেশন' বা পিএলসি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কিনা – জার্মানি দু'টি মুখ্য খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়, ক্যাথলিক গির্জা ও প্রটেস্টান্ট গির্জার যে স্বীকৃতি আছে৷ এর ফলে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট গির্জাটির হয়ে ঐ গির্জার সদস্যদের কাছ থেকে ‘গির্জা কর' সংগ্রহ করে থাকে৷ কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত একটি দেশব্যাপী কাঠামো না থাকার ফলে জার্মানিতে ইসলামধর্ম বা মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে পিএলসি-র মর্যাদা পাওয়া সমস্যাকর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায় ভিত্তিক ধর্মীয় স্বাধীনতা
জার্মানিতে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকলেও, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সহযোগিতা সম্ভব ও প্রথাগতভাবে বর্তমান৷ জার্মান জনজীবনে প্রটেস্টান্ট ও রোমান ক্যাথলিক, এই দু'টি প্রধান গির্জার প্রভাব সর্বত্র৷
ব্যক্তিগত ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে জার্মান আইনের যে বিশেষত্বটি লক্ষণীয়, সেটি হলো এই যে, কোনো ধর্মবিশ্বাস না থাকা, অথবা আদালতের নির্দেশ ব্যতিরেকে তা ঘোষণা করতে না চাওয়া – যেমন শিক্ষা বা কর্মস্থলে অন্য কোনো ধর্মের প্রতীক, রীতিনীতি বা আচার-আচরণের সম্মুখীন না হতে চাওয়াটাও ব্যক্তিগত ধর্মীয় স্বাধীনতার এই ‘নেতিবাচক' দিকটির অঙ্গ৷ এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে, ১৯৭৩ সালে এক ইহুদি একটি জার্মান আদালতে সাক্ষ্য দিতে চাননি, কেননা বিচারকক্ষে একটি ক্রুশ ঝুলছিল: তাঁর আপত্তিকে মান্য করা হয়৷ এর ২২ বছর পরে ১৯৯৫ সালে জার্মান সাংবিধানিক আদালত একটি রায় দেন, যা অনুযায়ী রোমান ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া বাদবাকি মুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রুশের মতো ধর্মীয় প্রতীক প্রদর্শন করাটা বেআইনি বলে বিবেচনা করা হয়৷ সেযাবৎ বিশেষ করে মুসলিম শিক্ষিকাদের সরকারি স্কুলে হিজাব পরিধান ও সাধারণভাবে মুসলিম মহিলাদের প্রকাশ্য স্থানে বোরকা পরিধান নিয়ে বারংবার বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়া ও বিতর্কের অবতারণা ঘটেছে৷
অপরদিকে জার্মানিতে হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য যৌনশিক্ষা অথবা বিবর্তনবাদের ক্লাসে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক, ধর্মীয় কারণে তা থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই৷ ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো অভিভাবকদের পক্ষে বাধ্যতামূলক – ধর্মীয় কারণে তাদের বাড়িতে রেখে পড়াশুনো করানো আইনগতভাবে অবৈধ৷
জার্মানিতে ইসলামের আইনগত পরিস্থিতি
ইসলাম জার্মানিতে ‘এন্টিটি আন্ডার পাবলিক ল', অর্থাৎ সার্বজনিক আইন দ্বারা স্বীকৃত ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়৷ এক্ষেত্রে মূল বাধা হলো জার্মানিতে ইসলামের বিভিন্ন ধারার অনুগামীদের উপস্থিতি: সুন্নি, শিয়া, আলাওয়াইট, আহমদি, সুফি, ইবাদি ও অপরাপর নানা সম্প্রদায়ের মুসলিম এখানে বাস করেন৷
দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে মুসলিমদের মাত্র ২০ শতাংশ কিংবা তার কিছু বেশি বিভিন্ন মুসলিম সমিতি ও তথাকথিত ‘আমব্রেলা' বা গোষ্ঠী সংগঠনগুলির সদস্য৷ জাতি ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট এই সব সমিতির ভিত্তি হলো সমিতি গঠন সংক্রান্ত আইন, যদিও তারা জার্মান সংবিধানের সাত নম্বর সূত্রের তৃতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘ধর্মীয় সমাজ' হিসেবে স্বীকৃতি পেতে, এমনকি পিএলসি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সচেষ্ট৷ আবার ঠিক ঐ বৈচিত্র্যের কারণেই রাষ্ট্র – অর্থাৎ ফেডারাল বা রাজ্য সরকারসমূহ ইসলামকে পিএলসি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নন৷ অপরদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন, খ্রিষ্টীয় গির্জাগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রের বোঝাপড়া হিসেবে সৃষ্ট ‘রাষ্ট্র-গির্জা-আইন' আজকের জার্মানিতে সমসাময়িক কিনা৷ যে ধরনের কেন্দ্রীয় সংগঠন ও নিয়মিত, নথিবদ্ধ সদস্যতা থেকে একটি বা একাধিক কেন্দ্রীয় ইসলাম সংগঠন সৃষ্টি হতে পারে, যাদের সঙ্গে সরকার আলাপ-আলোচনা চালাতে পারবেন, যেমন শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে চালিয়ে থাকেন – মুসলিমদের সে ধরনের সংঘবদ্ধতা বা সংগঠন জার্মানির ক্ষেত্রে অলীক৷ কিন্তু তা বলে জার্মানিতে যে ৪৪ থেকে ৪৭ লাখ মুসলিমের বাস – সর্বাধুনিক জনসংখ্যাগত জরিপ যা বলছে – দীর্ঘমেয়াদি সূত্রে তাদের সমষ্টিগত দাবিদাওয়াকে বিবেচনা করার কোনো না কোনো পন্থা উদ্ভাবন করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠতে পারে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷