খতনা বিতর্ক
২৬ আগস্ট ২০১২বিতর্কের ঝড়
কয়েক মাস আগে একটি চার বছরের ছেলের খতনা করানো নিয়ে এই বিতর্কের শুরু৷ খতনার সময় চিকিৎসকের ভুলে ওই বাচ্চার পুরুষাঙ্গ থেকে অতিরিক্ত রক্তপাত হলে, তা গড়ায় কোলন শহরের আদালত পর্যন্ত৷ আর আদালত রায় দেয়, বাচ্চার ধর্মীয় অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেটা তার নিজের শরীরের অধিকারের চেয়ে বেশি নয়৷ অর্থাৎ বাবা-মার ইচ্ছায় এখন থেকে খতনা করা বন্ধ৷ আর যদি করাতেই হয়, তাহলে ছেলে বড় হলে তার মতামত নিয়ে সেটা করতে হবে৷ তারপর থেকে এই নিয়ে বিতর্ক চলছে, থামছে না৷ কারণ কেবল মুসলমান নয় ইহুদিদের ধর্মীয় আচারের একটি অংশ হচ্ছে এই খতনা৷
এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিক এমনিক গবেষকরা পর্যন্ত৷ কেউ আদালতের রায়কে বাচ্চার অধিকারের সংরক্ষণ হিসেবে দেখছেন, অনেকে আবার এটিকে ধর্মে আদালতের অহেতুক হস্তক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করছেন৷ এই যেমন ইহুদি নেতা পিনশাস গোল্ডস্মিড্ট৷ ইউরোপের রাব্বিদের এই নেতা কোলনের আদালতের রায়ের তীব্র সমালোচনা করে বললেন, ‘‘যদি এই রায়কে সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করে এবং এটিকে আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার অর্থ হচ্ছে জার্মান সমাজের একটি বড় অংশের কোন ভবিষ্যত এই দেশে নেই৷''
আদালতের হস্তক্ষেপ
জার্মানির ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় প্রভাব গ্রহণ করা হয় না৷ অন্যদিকে ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়৷ তাই খতনার মতো ধর্মীয় আচারকে কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, বাচ্চার শারীরিক অধিকার হিসেবেও অনেকে দেখতে চান৷ যেমন জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে সবুজ দলের নেত্রী রেনাটে ক্যুনাস্ট বললেন, ‘‘আমি চাই জার্মানিতে ইহুদি ও মুসলমানরা যাতে তাদের ধর্মকানুন মেনে চলতে পারে৷ আবার অন্যদিকে নিজের শরীরের ওপর শিশুর যে অধিকার রয়েছে, সেটার প্রতিও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে৷ এটা কোনো সহজ বিষয় নয় এবং এই নিয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও যাবে না৷''
তবে সবুজ দলের আরেক রাজনীতিক ফোল্কা বেক কিন্তু ভিন্নমত জানালেন৷ ধর্মীয় সব বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মত জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘একটি উদার সমাজে রাষ্ট্র কখনো ধর্মীয় সংস্কারের দায়িত্ব তুলে নিতে পারে না, বরং ধর্মীয় সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে পারে৷''
বাচ্চাদের সিদ্ধান্ত
কোলনের আদালতের এই রায় নিয়ে গত জুলাই মাসে জার্মানির সংসদ সদস্যরা একটি খসড়া প্রস্তাব সংসদে তোলেন৷ এতে খতনার ধর্মীয় অধিকার বহাল রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়৷ তবে অনেকেই আছেন যারা আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা করছেন এবং তা মেনে নিয়েছেন৷ তাদের একজন মেহমেত কিলিশ৷ জার্মান সংসদের এই মুসলিম সদস্য আদালতের রায় অনুসারে ছেলের খতনা করানো থেকে বিরত থাকছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘এই রায় না আসলে হয়তো এই গ্রীস্মেই আমি আমার এক ও আট বছরের দুই ছেলের খতনা করিয়ে ফেলতাম৷ এই রায়ের পর আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি৷ এবং এরপর আমরা খতনা না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ এটা আমরা আমাদের সন্তানের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছি৷ আমরা মনে করি, এটা বাচ্চাদের মতামত নিয়ে করাই ভালো হবে৷''
নৈতিক বিতর্ক
এরপরও কিন্তু বিতর্ক থামছে না৷ আদালতের এই রায় মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ কিনা আর সেটা হয়ে থাকলে তা কতটুকু নৈতিক, সেই বিতর্ক এখন আবার শুরু হয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে ডয়চে এথিকরাট বা জার্মানির নৈতিকতা পরামর্শ কেন্দ্র৷ এখানকার একমাত্র মুসলিম সদস্য ইলহান ইলিচ এই ব্যাপারে বললেন, ‘‘নৈতিক দিক থেকে আমি মনে করি যে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সবকিছুই আইনগতভাবে পরিচালিত হওয়ার দরকার নেই৷ তবে এখন বিতর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আমার সন্দেহ যে আইন না করে বিষয়টির সুরাহা করা আদৌ সম্ভব কিনা৷''
প্রতিবেদন: কারিন ইয়েগার / উলরিখ পিক / রিয়াজুল ইসলাম (এএফপি, ডিপিএ)
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ