জার্মানিতে গাড়ি চালানোর ‘কঠোর’ নিয়মনীতি
২৮ আগস্ট ২০১১জার্মানিতে গাড়ি চালানো নেহাত আনন্দের ব্যাপার৷ ঐতিহাসিক বিভিন্ন শহর, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মোটের উপর ইউরোপের অন্যান্য দেশে সড়ক যোগাযোগের সুবিধা৷ গাড়ি থাকলে কিংবা গাড়ি চালানোর অনুমতি থাকলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাই বাড়তি স্বাধীনতা পাওয়া যায়৷
জার্মান আউটোবান
জার্মান আউটোবান মানে মহাসড়ক বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ৷ এই আউটোবানের মোট ব্যাপ্তি সবমিলিয়ে ১২,৮০০ কিলোমিটারেরও বেশি৷ আউটোবান ব্যবহার করে এই দেশের যেকোন শহরে পৌঁছানো সম্ভব৷ শুধু তাই নয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মহাসড়কের সঙ্গে জার্মান আউটোবানের সংযোগ রয়েছে৷
দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষা
এমন সুবিধার কারণে গাড়ি চালানোর আনন্দটা জার্মানরা কিংবা জার্মানিতে বসবাসকারী অভিবাসীরা অবশ্যই নিতে চাইবেন৷ এই দেশে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে রয়েছে অগুনতি প্রতিষ্ঠান৷ তবে, গাড়ি চালানোর শিক্ষার নিয়মকানুন সব প্রতিষ্ঠানেই এক৷ মূলত দুই ভাগে জার্মানিতে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়৷ প্রথমত, তাত্ত্বিক জ্ঞান এবং দ্বিতীয়ত ব্যবহারিক জ্ঞান৷ লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে দুটি অংশের পরীক্ষায় আলাদাভাবে উত্তীর্ণ হতে হয়৷ তবে সবার আগে দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসার এক দিনের কোর্স করতে হয়৷
জার্মানির বন শহরে বসবাসরত তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার সম্প্রতি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন৷ তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, গাড়ি চালানোর তাত্ত্বিক জ্ঞান বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে? তিনি বলেন, একজন চালকের নিরাপদে গাড়ি চালাতে যে সমস্ত জ্ঞান দরকার, এগুলো তাত্ত্বিক বিষয়ে সেখানো হয়৷ যেমন গাড়ি সঠিকভাবে পরিচালনা, রক্ষনাবেক্ষণ, ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং সাইনগুলো কিভাবে খেয়াল করতে হয় এসব শেখানো হয়৷ এছাড়া কোন পরিস্থিতিতে কি ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তাও জানানো হয়৷ সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একজন চালক যে গাড়ি চালানোর মধ্য দিয়ে অন্যদের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, সেটির তাত্ত্বিক অংশে বোঝানো হয়৷
নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন
থিয়োরি পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন করা হয়৷ এক্ষেত্রে একটি প্রশ্নের উত্তর একাধিক হতে পারে৷ একাধিক উত্তরের ক্ষেত্রে একটি উত্তর প্রদান করলে, সেটি ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়৷ সহস্রাধিক প্রশ্নের মধ্যে থেকে বিভাগ অনুযায়ী যেকোন ত্রিশটি প্রশ্ন পরীক্ষায় আসতে পারে৷ থিয়োরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে কমপক্ষে ২৭ বা ২৮টি প্রশ্নের উত্তর সঠিক হতে হবে৷ খেয়াল রাখতে হবে, কোন প্রশ্নের উত্তর ভুল হলে, সেই ভুলকে একাধিক নেতিবাচক পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এই নেতিবাচক পয়েন্টের সংখ্যা ১০ এর বেশি হলেই আপনি অকৃতকার্য হলেন৷
ব্যবহারিক জ্ঞান
তাত্ত্বিক জ্ঞানের এই জটিল পরীক্ষা শেষে হওয়ার পর ব্যবহারিক পালা৷ আবুল বাশার জানালেন, ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগে নতুন লাইসেন্সপ্রার্থীরা ২০ থেকে ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালনা চর্চা করেন৷ ড্রাইভিং স্কুলের বিশেষ গাড়ি এবং প্রশিক্ষকের উপস্থিতিতে এই চর্চা করতে হয়৷ তিনি বলেন, প্রাকটিক্যাল অংশে মূলত তাত্ত্বিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে গাড়ি চালনার দিকেই জোর দেওয়া হয়৷ কোন ধরনের রাস্তায় কোন কোন বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে সেগুলো চর্চা করানো হয়৷ অনেকেই ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর চর্চা করার পর পরীক্ষায় অংশ নেন৷
কয়েকটি নিয়ম
জার্মানিতে গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে নজর রাখতে হয়৷ যেমন, শহরের মধ্যে সাধারণত ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার এর বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যাবে না৷ সাধারণ মহাসড়কে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি হতে পারে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার৷ জার্মান আউটোবানে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি আরো বেশি, ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত৷ কিছুক্ষেত্রে অবশ্য গতির কোন সীমাবদ্ধতা নেই৷ তবে, আউটোবানগুলো বিশেষভাবে সুরক্ষিত থাকে৷ আউটোবানে কোন মানুষ গাড়ি ছাড়া প্রবেশ করতে পারেনা৷ তাছাড়া আউটোবানগুলো মূল শহরের বাইরের দিকেই থাকে৷
মদ্যপান
জার্মান আইন অনুযায়ী, নবীন গাড়ি চালকরা প্রথম দু'বছর একেবারে সামান্য মদ্যপান করেও গাড়ি চালাতে পারবেন না৷ এই সময়কালে অন্য কোনো মারাত্মক ভুল করলেও কপালে দুঃখ রয়েছে৷ দু'বছর পরই লাইসেন্স চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায়৷ তারপর সাধারণ চালকরা গাড়িতে চড়ার আগে খুবই কম মাত্রায় মদ্যপান করতে পারেন, এটির নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে৷ মাত্র এক গ্লাস বিয়ার পান করলেই রক্তে অ্যালকোহলের সেই মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে ধরা পড়লে লাইসেন্স বাতিল, জরিমানা, কারাদণ্ডসহ নানাবিধ শাস্তি হতে পারে৷ এমনকি রাতে মদ্যপান করলে পরদিনও ধরা পড়ার ভয় রয়েছে৷
এমন কড়া সব নিয়মকানুন মেনেই কিন্তু গাড়ির লাইসেন্স গ্রহণ করছেন জার্মানরা৷ এই দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি নাগরিকের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স রয়েছে৷ সতের বছর বয়সেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায়৷ তবে একা গাড়ি চালানো যায় ১৮ বছর বয়স থেকে৷
প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন