জার্মানির অবহেলিত শিশুরা
২৮ আগস্ট ২০১৩জার্মানিতে সম্প্রতি শিশুহত্যা, অপরদিকে দুধের শিশুদের নির্মম অবহেলা করার একাধিক ঘটনা শুধু ইয়েলো প্রেসকেই নয়, গোটা সমাজ ও সেই সঙ্গে রাজনীতিকেও সচকিত ও আলোড়িত করেছে৷ আনা নামের একটি ছোট মেয়েকে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে যে দম্পতির কাছে রাখা হয়েছিল, তাদের অবহেলায় সে বাথটবে ডুবে মারা যায়৷ কেভিন বলে একটি ছোট ছেলের লাশ তার সৎ বাবার রেফ্রিজারেটরে পাওয়া যায়৷ এ সব ঘটনা কোনো সাধারণ খবর নয়৷ জার্মানির মানুষ চেষ্টা করলেও সহজে এগুলো ভুলতে পারবে না৷
ফেডারেল পরিসংখ্যান কার্যালয়ের বিবরণ অনুযায়ী জার্মানির শিশুকল্যাণ দপ্তর ২০১২ সালে ৪০ হাজারের বেশি অপ্রাপ্তবয়স্কদের তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে, যা কিনা একটা রেকর্ড৷ অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ৷ পরিবারে শিশু-কিশোরদের বিপদ ঘটার সম্ভাবনা দেখলে ‘ইউগেন্ডআম্ট' তাদের নিজের তত্ত্বাবধানে নিতে পারে৷ সাধারণত এটা সাময়িকভাবে করা হয় এবং পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে এলে শিশু-কিশোররা তাদের নিজেদের পরিবারে ফিরে যেতে পারে৷
যখন একা
জার্মানিতে অধিকাংশ বাবা-মায়েরা থাকেন চাপের মুখে – চাকুরির চাপ, দৈনন্দিন জীবনের চাপ, তার উপর আবার সন্তান প্রতিপালনের চাপ৷ তাঁদের পক্ষে সব সময়ে সেই চাপ সামলে ওঠা সম্ভব হয় না, বিশেষ করে কম বয়সের বাবা-মায়েদের পক্ষে৷ এ কথা জানিয়েছেন কোলোন শহরের ইউগেন্ডআম্ট-এর কর্মকর্তা রেনাটে শেফার-সিকোরা৷ তরুণ বাবা-মায়েরা আবার এই আধুনিক সমাজে সত্যিই একা; যৌথ পরিবারের সাহায্য তো দূরের কথা, যে শহরে কাজকর্ম এবং বাস, সেখানে হয়তো কোনো আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাক্ষাৎ পাওয়াই ভার৷
কাজেই একা বোঝা সামলাতে হয়তো ধূমপান ও মদ্যপান বাড়ে, এমনকি মাদক সেবন৷ আসে মানসিক অবসাদ, বিষাদ, রোগ৷ সেই অনুপাতে পরিবারের শিশুদের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে৷ বিশেষ করে যেখানে বাবা-মায়েরা নিজেরাই সবে কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দিয়েছেন, তাদেরই সবার আগে ভেঙে পড়ার বিপদ থাকে, দেখেছেন রেনাটে শেফার-সিকোরা৷ তবে সব মিলিয়ে শিশুদের প্রতি অবহেলা কিংবা শিশু নিপীড়ন বেড়েছে বলে মনে করেন না তিনি৷
প্রতিবেশীদের নজর
যেটা বেড়েছে, সেটা হল সাধারণভাবে সমাজে শিশুদের কল্যাণ সম্পর্কে সচেতনতা, বলেন শেফার-সিকোরা৷ প্রতিবেশীরাই প্রথমে খেয়াল করেন যে, কোনো শিশুর চেহারা, পোশাক-আশাকে কোনো গোলমাল আছে৷ কোনো বাড়িতে হয়তো শিশুর কান্না থামছে না৷ প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ শিশু কল্যাণ দপ্তরে টেলিফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দেন৷ তারপর ইউগেন্ডআম্ট লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেয় এবং প্রয়োজনে সেই শিশুকে দূষিত পারিবারিক পরিবেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় – তা সে সাময়িকভাবে হোক আর দীর্ঘমেয়াদি ভাবেই হোক৷
শিশুদের যৌন নিপীড়ন কিংবা অপব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাই৷ মিডিয়ায় প্রকাশ্য রিপোর্টিং ও আলোচনার ফলে বিষয়টি অনেকদিন আগেই পারিবারিক ধোঁয়ান্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ আজ আর কিশোর-কিশোরীরা তাদের যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত খবরাখবর সোজা শিশু কল্যাণ দপ্তরকে জানাতে আগের মতো অতোটা দ্বিধা বোধ করে না৷ শুধু নিজেদের সম্পর্কেই নয়, বাবা-মায়ের সম্পর্ক, বিরোধ ইত্যাদি নিয়েও খোলাখুলি কথাবার্তা বলে এই কিশোর-কিশোরীরা৷
কাজেই জার্মানিতে ‘অনাথ' শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে, সরকারি খরচে তাদের ‘হোম'-এ রেখে মানুষ করতে হচ্ছে – এ ধরনের রগরগে শিরোনামের কোনো প্রয়োজন নেই৷ বাস্তবে ঘটনাটা যা ঘটছে, তা হলো এই যে, প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট শিশুদের এবং পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট বাবা-মায়েদের সাহায্য করা হচ্ছে৷ যার ফলে শেষমেষ উপকৃত হচ্ছে সমাজ ও সংস্কৃতি৷