জার্মানির প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম জানেন?
১১ ডিসেম্বর ২০১৮ইউরোপের দেশ জার্মানির প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম সংক্রান্ত প্রশ্নটি করেছেন আসলে প্রকৌশলী মীর মোনাজ হক৷ বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে ডয়চে ভেলের আয়োজিত টক শো-তে এই প্রশ্নটি করেন তিনি৷
জার্মানির আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্রের বন কার্যালয়ে আয়োজিত সেই টক শো-তে তখন অতিথি এবং দর্শক মিলে জনাপঞ্চাশেক লোক উপস্থিত ছিলেন৷ তাঁদের কেউই তাৎক্ষণিকভাবে মোনাজ হকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি৷ অথচ সেখানে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম জানতে চাইলে সবাই হেসেই খুন হতেন৷
মোনাজ হকের এই প্রশ্ন জার্মানির রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরেছে৷ জাতীয় নির্বাচন এই দেশে একটি স্বাভাবিক এবং সাধারণ ব্যাপার৷ এদেশে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে কিনা এমন চিন্তা কাউকে করতে দেখা যায় না৷ বরং নির্বাচনের দিন ভোট দেয়া নিয়ে হৈচৈয়ের বদলে সাধারণ মানুষকে দেখা যায় অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে৷
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের কথাই ধরুন৷আমাকে এক সহকর্মীসহ বার্লিন পাঠানো হলো নির্বাচন কভার করতে৷ তো নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি জার্মানির রাজধানী থেকে৷ হঠাৎ নির্বাচনের আগের রাতে খেয়াল করলাম বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে৷ পুলিশের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো৷
আমি জানি, জার্মানির রাজধানীতে ভোট গ্রহণের দিন অপ্রীতিকর কিছু ঘটবে এমন আশঙ্কা তেমন একটা নেই৷ তারপরও পুলিশের বাড়তি কড়াকড়ি দেখে এক জার্মান সহকর্মীকে প্রশ্ন করলাম৷ তিনি জানালেন, ভোটের দিন আসলে বার্লিনে অনেক বড় এক ম্যারাথন হবে৷ সেই ম্যারাথনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের এত দৌঁড়ঝাঁপ৷ ভোটের দিন নিয়ে তাদের আলাদা কোনো প্রস্তুতি নেই৷
ভোটের দিন এক ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলাম জার্মানির নাগরিকত্ব আছে এমন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতা জানতে৷ যে এলাকায় গিয়েছিলাম, শুরুতে সেই এলাকার ভোটকেন্দ্র খুঁজে পেতে একটু কষ্টই হয়েছিল৷ সেখানে ছিল না কোনো ভিড়, কোনো দলের কোনো ধরনের বুথ, এমনকি কোনো পুলিশ সদস্যও৷ তবে মাঝেমাঝে দু-একজনকে ভোট দিতে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছিল৷ কেউ কেউ আবার ভোটকেন্দ্র থেকে নীরবে বেরও হয়ে যাচ্ছিলেন৷ ভোটারদের একটু বাড়তি সমীহ করার কোনো চিহ্ন ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে দেখতে পাইনি৷
শুধু তাই নয়, ভোটকেন্দ্রের ভেতরেও বাড়তি কারো উপস্থিতি চোখে পড়েনি৷ বরং বিশাল এক ভবনের মধ্যে মাঝারি আকারের এক রুমে চলছিল ভোটগ্রহণ৷ সেখানে ভোটারের বাইরে দশ জনের মতো উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা ভোটার তালিকা পরীক্ষা এবং ভোটারদের নানা কাজে সহায়তা করছিলেন৷ সেই কেন্দ্রের ভেতর থেকে তখন ফেসবুক লাইভ করতেও কেউ কোনো বাধা দেয়নি৷
এত কথা বলছি এজন্য যে, জার্মানিতে ভোট গ্রহণ কিভাবে হবে, কিংবা নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন তা নিয়ে আমাদের দেশের মতো মাসের পর মাস বিভিন্ন দলকে লড়াই করতে দেখা যায় না৷ বরং এঁদেশে সবাই জানেন যে, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং সেটি সম্পূর্ণ স্বাধীন৷ ক্ষমতাসীন দল কিংবা সরকারের সেই কমিশনের উপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই৷ তাই, সেই কমিশনের কে প্রধান বা কারা কমিশনার, তা জানা আসলে সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই জরুরি নয়৷ মোনাজ হকের প্রশ্নের উত্তর তাই টক শো-তে উপস্থিত কারোর পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি৷
এখানে আরো একটি বিষয় জানানো প্রয়োজন৷ জার্মানির জাতীয় নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপরেও কাউকে নির্ভর করতে দেখা যায় না৷ রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশি পর্যবেক্ষক আনার দাবি জানায় না৷ তারপরও ইন্টারনেটে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে যা পেলাম, তা হচ্ছে গত নির্বাচনের সময় ওএসসিই তিন সদস্যের একটি ‘ইলেকশ এক্সপার্ট টিম' পাঠিয়েছিল জার্মানিতে৷ সেই টিম ফিরে গিয়ে একটি রিপোর্টও লিখেছিল৷ তবে সেই রিপোর্টে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে এমন কোনো কিছুই নেই৷ আর সেই রিপোর্ট নিয়ে গণমাধ্যমেও কোনো প্রতিবেদন পাইনি৷
আমি আশা করি, আমাদের দেশেও একসময় জার্মানির মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে, যখন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কারো প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন হবে না, কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মুখাপেক্ষী হতে হবে না৷ বরং জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ের বদলে রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হবে ভোটারদের সন্তুষ্ট করে ক্ষমতায় যাওয়া৷ বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে জনগণই হোক সকল ক্ষমতার উৎস৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷