জীবন বাজি রেখে সম্মুখ যুদ্ধ করেছি
৫ মার্চ ২০১১‘‘মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও খাবার সরবরাহ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা থেকে শুরু করে গোয়েন্দাগিরি, সম্মুখ যুদ্ধ, যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ এবং রাজাকার ও পাক বাহিনীর হাতে বন্দি৷ শত্রুসেনায় বন্দি অবস্থায় শারীরিক ও যৌন নির্যাতন৷ এতো কিছুর বিনিময়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার পরও আজ বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরতে হচ্ছে আমাদের৷ সরকার কি পারে না এসব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যে আবাসন, খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে? স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন অধিকাংশ বীর সাহসী সৈনিক৷ মাত্র কিছুদিন পরেই হয়তো ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ আর বেঁচে থাকবেন না৷ অথচ এখনও আমরা চিকিৎসা কিংবা যথাযথ মান-সম্মান পেলাম না এই জাতির কাছ থেকে৷'' ডয়চে ভেলের সাথে টেলিফোন সংলাপে অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে কথাগুলো বলছিলেন নারী মুক্তিযোদ্ধা হালিমা পারভীন৷ নিজের অসুখের কথা বলতে গিয়ে হালিমা বললেন, ‘‘বিনা ওষুধেই আমি মারা যাচ্ছি৷ আমার শরীরে তো হরমোন তৈরি হয় না৷ বাইরে থেকে হরমোন সরবরাহ করতে হয়৷ অথচ তা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে আমি নিয়মিত সেই চিকিৎসা করতে পারি না৷''
যশোরের বাঘারপাড়ায় ১৯৫৬ সালের ৩ এপ্রিল জন্ম হালিমার৷ পিতা ইসরাইল বিশ্বাস এবং মা আমেনা খাতুন৷ ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন গ্রামের এক দুরন্ত মেয়ে হালিমা৷ নবম শ্রেণীতে পড়তেন৷ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে গ্রামের তরুণ, ছাত্র, জনতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য স্থানীয় সংগঠন গড়ে তোলেন৷ সেই সংগঠনের শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকেন হালিমা৷ মামার বাড়িতেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি৷ ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি৷ পুরুষ যোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন৷ বাঘারপাড়া থানা থেকে লুট করে আনেন ১৬ টি রাইফেল৷ পাক সেনা ও রাজাকারদের অনুপ্রবেশ ও যাতায়াত ঠেকাতে রাতের অন্ধকারে ধ্বংস করেছেন বাঘারপাড়া-নারিকেলবাড়িয়া সড়কের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু৷ ডয়চে ভেলের সাথে আলাপচারিতায় জানালেন যুদ্ধের সময় তাঁর নানা বীরত্বপূর্ণ ঘটনার কথা৷
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অভিযানে হালিমার এমন সক্রিয় ভূমিকার জন্য এমনকি পাক সেনা ও রাজাকাররা হালিমাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষণা করেছিল ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার৷ এক পর্যায়ে আগস্ট মাসে এক সম্মুখ যুদ্ধের সময় গুলিবিদ্ধ হন হালিমা৷ ঐদিনের ঘটনা তুলে ধরেন হালিমা৷ তিনি জানান, গুলি খাওয়া সত্ত্বেও তাঁর হাতে থাকা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারেন৷ কিন্তু এরপরই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি৷ ধরা পড়ে যান পাক সেনা ও রাজাকারদের হাতে৷ প্রথমে বেয়নেটের আঘাতে জর্জরিত করে হালিমাকে সেনা শিবিরে ধরে নিয়ে যায় পাক বাহিনী৷ দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে পাক সেনাদের হাতে আটক ছিলেন তিনি৷ এসময় তাঁর উপর চালানো হয় নির্মম শারীরিক ও যৌন নির্যাতন৷ ৭ ডিসেম্বর যশোর শত্রুমুক্ত হলে তিনিও অন্যদের সাথে বন্দি দশা থেকে মুক্তি পান৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক