জীবনের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য জীবন নয়
৩ ডিসেম্বর ২০১৪নাম: জেমস কোফি আনান৷ মাত্র ছয় বছর বয়সে তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঘানার ভোল্টা হ্রদের কাছে, মাছ ধরার জন্য৷ দিনে প্রায় সতেরো ঘণ্টা কাজ করতে হতো জেমসকে৷ তারপরেও বলার মতো একটা বাসস্থান তো বটেই, পেট ভরা খাওয়ারও দেওয়া হতো না৷ দীর্ঘ সাত বছর নানা অন্যায়, অবিচার সহ্যের পর, একদিন পালিয়ে যায় জেমস৷ পড়াশোনা করে, ব্যাংকে চাকরি নেয় এবং গড়ে তোলে ‘চ্যালেঞ্জিং হাইটস' নামে শিশুশ্রম বিরোধী এক প্রতিষ্ঠান৷
২রা ডিসেম্বর দাসপ্রথা এবং মানবপাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তিটি খোদ ভ্যাটিকানে স্বাক্ষরিত হলেও, চুক্তিটি পড়ে শোনান তরুণ জেমস৷ খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস, হিন্দুধর্মের সাধিকা অমৃতানন্দময়ী (আম্মা), শিয়া এবং সুন্নি – দুই ঘরানার ইসলামানুসারী ইমাম, ইহুদিদের রাব্বি, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বী বহু বিশিষ্ট নেতার সামনে সে বলে, ‘‘চলুন আমরা সবাই একসঙ্গে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই৷ পৃথিবীতে যাঁদের পাশে কেউ নেই, যাঁরা নিঃস্ব, অত্যাচারিত, যাঁদের আজও বেচা-কেনা করছে বিত্তশালীরা – তাঁদের পাশে থাকি৷ চলুন সমাজে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করি আমরা৷''
সঙ্গে সঙ্গেই হাততালি আর তার পরমুহূর্তে চুক্তি সই৷ কোথায় যেন একটা খটকা লাগলো৷ জেমসের আগে একে একে সকলে যে যাঁর বক্তব্য পেশ করছিলেন৷ মানবপাচার, শিশুশ্রম এবং তার সঙ্গে মানবাঙ্গের কেনা-বেচাকে তুলে ধরে দাসপ্রথা অবলুপ্তির শপথ নিলেন পোপ ফ্রান্সিস৷ বললেন দাসপ্রথা এবং মানবপাচার শিশুর স্বপ্নকে হত্যা করে৷ আম্মাও ভারতের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে জীবিকার জন্য শিক্ষা এবং জীবনের জন্য শিক্ষার কথা বললেন৷ধর্ম, ধর্ম পালন আর আধ্যাত্মিকতা যে মানুষকে সঠিক পথে পথ চলায় সাহায্য করে, অপরকে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের চোখে দেখতে শেখায় – সে কথাও বললেন ‘জেন বুদ্ধিজম' এবং ইসলাম ধর্মের নেতারা৷ কিন্তু আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে ধর্মগুরুদের এই মোটা মোটা কথা আমার কাছে কেন যেন অন্তঃসারশূন্য মনে হলো৷
শুধু ধর্মাচরণ করলেই কি মানুষ মধ্যযুগীয় দাসপ্রথাকে ভুলে যাবে? ভুলে যাবে সব রকম ভেদাভেদ, অর্থনৈতিক স্বার্থ? মনে তো হয় না....আমার মনে হয়, জীবনের জন্য ধর্ম হওয়া উচিত, ধর্মের জন্য জীবন নয়৷ তাই ইটালীয়, স্প্যানিশ, ইংরেজি, ফরাসি, আরবি – এ সব ভাষায় বিশ্বের সমস্ত ধর্মের আদি কথা শুনতে শুনতে আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাই৷ ভ্যাটিকানের প্রাসাদ যেন আমায় গিলতে আসে৷ ভাবি, ধর্মের এত কচকচির প্রয়োজন কী? ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য' – এ কথা মানলেই কি যথেষ্ট নয়?
তবে বিশ্বধর্মের নেতাদের একেবারে সামনে থেকে দেখে এটা বুঝতে পারি যে, এঁরা যা বলছেন তা যদি সত্য হয়, তাহলে বেদ, পুরাণ, বাইবেল, কোরান – সব ধর্মগ্রন্থই কিন্তু একই কথা বলছে৷ বলছে ঈশ্বরের চোখে সব মানুষ সমান৷ নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ধার্মিক-অধার্মিক – সকলেই সমান, সকলেই এক৷ আর সেই মানবের স্বাধীনতাকে যা খর্ব করে, তা অবশ্যই অপরাধ৷
তাই ভ্যাটিকানের বিখ্যাত ‘পেট্রিয়ানো গেট' থেকে বের হতে হতে মনে হলো, আল-আজহার সর্বোচ্চ ইমাম যদি এক নিশ্বাসে সব ধর্মের উল্লেখ করতে পারেন, মা অমৃতানন্দময়ী যদি শুধুমাত্র ভালোবাসার জোরে অগুন্তি ভক্তের কাছে ‘আম্মা' হয়ে উঠতে পারেন আর পোপ ফ্রান্সিস যদি আমার মতো সাধারণ একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে একটা ‘সেল্ফি' তোলার জন্য হাসতে হাসতে রাজি হতে পারেন, তাহলে হয়ত, কে জানে, ধর্মের সঠিক ব্যবহার সকলের জন্য মানবাধিকারটাও নিশ্চিত করতে পারে!