‘জ্বালানি তেলের বিষয় ভোক্তা অধিদফতরের বাউন্ডারির বাইরে’
১২ নভেম্বর ২০২১ভোক্তাদের স্বার্থ দেখার জন্য ২০০৯ সালে গঠন করা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর৷ কিন্তু তারা ভোক্তাদের স্বার্থে কী করছে? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বাবলু কুমার সাহা৷
ডয়চে ভেলে : ভোক্তা অর্থাৎ জনগণের দূর্ভোগ এবং ভোগান্তি দূর করতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব কতটুকু?
বাবলু কুমার সাহা : একটু পেছন থেকে বলি, বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী মেয়াদে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ জাতীয় সংসদে পাস হয়৷ এই আইনটি বাস্তবায়ন করার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়৷ এই অধিদফতরের কাজ মূলত তিনটি৷ একটি হল, আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা কোন দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে বা ইন্ড্রাস্ট্রিতে বা কোনো হোটেল রেস্তোরাঁয় গিয়ে সরাসরি অভিযান বা তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন৷ আমাদের কাছে যদি মনে হয় ওই ব্যবসায়ী নিয়ম নীতি না মেনে ব্যবসা করছেন তাহলে তাকে আমরা শাস্তির আওতায় আনতে পারি৷ দ্বিতীয় কাজটি হল, কোন ক্রেতা বা ভোক্তা বাজারে গিয়ে কোনো পণ্য কিনে বা সেবা নিতে গিয়ে ঠকেছেন বা প্রতারিত হয়েছেন মনে করেন তাহলে তিনি আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন৷ সেটা তিনি অফিসে এসেও করতে পারেন অথবা অনলাইনেও করতে পারেন৷ এমন অভিযোগ পাওয়ার পর আমাদের কর্মকর্তারা উভয়কে নোর্টিশ দেন৷ সেখানে আমরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই৷ তার অর্থ এই নয়, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ খাটো করে দেখা হয়৷ যারা নীতি নৈতিকতা নিয়ে ব্যবসা করে আমরা সবসময় তাদের প্রমোট করি৷ শুনানিতে যদি অভিযোগকারী প্রমাণ করতে পারেন তিনি ঠকেছেন বা প্রতারিত হয়েছেন তাহলে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকি৷ অর্থাৎ তাকে শাস্তি দিয়ে থাকি৷ এই আইনের ইউনিক একটা বৈশিষ্ট্য হল, এখানে অভিযোগকারী যদি অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আদায় করা জরিমানার অর্থের ২৫ শতাংশ তিনি প্রণোদনা হিসেবে পেয়ে থাকেন৷ আর তৃতীয় আরেকটি কাজ করি, সেটা হল সচেতনতামূলক কার্যক্রম৷ জরিমানা করা, শাস্তি দেওয়া অধিদফতরের উদ্দেশ্য নয়৷ আমাদের উদ্দেশ্য হল, সরকার প্রণোদিত নিয়ম নীতি মেনে যেন সবাই ব্যবসা করেন৷ এই কারণে আমরা বছরব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকি৷
আপনারা এমন পদক্ষেপ কি নিতে পারছেন যার মাধ্যমে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষিত হয়?
আমি এই অধিদফতরের প্রধান হিসেবে আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি গত জুন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে সমস্ত অভিযোগ এসেছিল তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি করেছি খুব অল্প সময়ের মধ্যে৷ ভোক্তাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না, একবার আসলেই হয়৷ তার প্রণোদনার অর্থ আমরা অনলাইনে তাকে পাঠিয়ে দেই৷ এই আইনে প্রতি বছর অন্তত ৪০ কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে৷ আমরা সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়েই কাজটা করার চেষ্টা করি৷
প্রতিবছর বিভিন্ন উপলক্ষে, নানান কৌশলে গ্রাহক এবং ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে৷ এবার যেমন তেলের মূল্য বাড়ানো হল এবং গ্রাহকদের দিকটি একেবারেই বিবেচনায় নেওয়া হল না৷ এখানে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কি?
প্রত্যেক আইনে, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের একটা বাউন্ডারি থাকে৷ জ্বালানি তেলের বিষয়টি আমাদের বাউন্ডারির বাইরে৷ আমরা যে জিনিসটি দেখে থাকি ভোক্তাদের স্বার্থে সরকার যে ভাড়াটি নির্ধারণ করে দিয়েছে, কিন্তু নেওয়া হচ্ছে বেশি৷ কেউ অভিযোগ করলে, সেটা প্রমাণ হলে আমরা শাস্তি দিয়ে থাকি৷ অনেক পরিবহন মালিককে আমরা জরিমানা করেছি৷ আবার পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ী যখন কিনে আনবেন তার কাছে যেন একটা ক্যাশমেমো বা চোথা যাই বলুন না কেন সেটা যেন থাকে৷ ওই কাগজ দেখলে আমরা বুঝতে পারি, কিনেছে কত দিয়ে আর বিক্রি করতে কত দামে? আমরা কিন্তু পরিবহন খরচ, দোকান ভাড়া সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই বিচার করি৷ ফলে বিক্রয়মূল্য কত হতে পারে সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারি৷ কিন্তু সেই ফারাকটা যদি বেশি হয় তখন আমরা ওই দোকানিকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসি৷
সরকার তেলে চলা বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করলেও দেখা যাচ্ছে গ্যাসে চলা গাড়ির ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে৷ আপনরা কি গ্রাহকদের বাঁচাতে এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন?
এ বিষয়ে আমি বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনাকে আলোচনা করতে বলব৷ কারণ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষই ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে৷
আইনে তো আপনাদের অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে৷ তার কতোটা ব্যবহার করতে পারছেন?
আমরা সাধ্যমত, যতটুকু যেখানে প্রয়োজন সেটা করছি৷ প্রশাসনিক বিষয়ে আমরা জরিমানা করতে পারি, জেল দিতে পারি৷ জেল দিতে গেলে আমাদের আদালতে গিয়ে মামলা করতে হয়৷ আমাদের আরোপিত শাস্তি যদি কেউ মানতে না চান তাহলে আমরা তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারে৷ ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা সুপারিশ করতে পারি৷ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা এই অধিদফতরের আছে৷
আপনাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়?
সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা জনবল৷ আমাদের জেলা পর্যায়ে একজন অফিসার আর একজন সহকারী৷ এই দিয়ে আমাদের জেলা অফিস চলছে৷ আমরা অনেক চেষ্টা করে ২ হাজার ৬৫ জন জনবলের জন্য লিখেছিলাম৷ নানান প্রক্রিয়া পার হতে হতে আমরা ১৪৮ জন পেয়েছি৷ হয়ত এটা শেষ হলে আবার লেখা হবে৷ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কিন্তু জনগণের আস্থায় জায়গায় চলে এসেছে৷ সুতরাং জনগণকে আস্থায় রাখতে গেলে জনবল বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই৷ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ সরকারও চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ সরকার বলতে এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কথা আমি বলছি৷
প্রায়ই দেখা যায় গ্রাহকদের জিম্মি করে অনেকেই তাদের স্বার্থ হাসিল করে৷ যেখানে আখেরে গ্রাহকদেরই ক্ষতি হয়৷ এই বিষয়গুলোতে আপনাদের ভূমিকা কী?
আমরা যেখানে অভিযোগ পাই, সেখানেই অভিযান চালাই৷ আমরা তদারকিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি৷ যদিও আমাদের স্পেশাল কোন ইন্টেলিজেন্স নেই, তারপরও আমরা নিজেরাই বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করি৷ আমাদের দ্বার কিন্তু ভোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত৷ তারা যদি সঠিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করে তাহলে আমরা সেটা এড্রেস করি৷
সামান্য কিছু জরিমানা করা ছাড়া সেই অর্থে আপনাদের কোনো ভূমিকাই দৃশ্যমান না৷ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
সামান্য কিছু জরিমানা, এটা বলা যাবে না৷ একটা উদাহরণ দেই, ১৫ টাকার পনির জন্য ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি৷ এটাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য প্রচলিত আইন যেটি আছে সেটি সংশোধনের কাজ হাতে নিয়েছি৷ এর মধ্যে আমরা ই-কমার্সকেও নিয়ে আসব৷ কোন কোন ক্ষেত্রে শাস্তি বা জরিমানার বিষয়টি বাড়ানোর কথাও আমরা ভাবছি৷ এখন ১০টি সেবার মধ্যে আমাদের কাজ সীমাবদ্ধ আছে, সেটি হয়ত আরও বাড়বে৷ এটা নিয়ে কাজ চলছে৷
একটা সময় মোবাইল ফোনে গ্রাহক ভোগান্তির কিছু মীমাংসা আপনারা করেছেন৷ এখন আর সেগুলোও হচ্ছে না৷ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সামনে দিয়েই ই-কমার্সে গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেল৷ এই বিষয়গুলোতে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল?
প্রথমত, মোবাইলের ক্ষেত্রে বড় বড় দুইটি প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছে৷ হাইকোর্ট সবার উপরে৷ আদালতের যে নির্দেশনা আছে, সে অনুযায়ী আমরা চলছি৷ ফলে এই অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না৷ একইভাবে ধরেন, ই-কমার্স৷ এখানে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান আছে৷ গত ৩০ জুন পর্যন্ত মাত্র ১৯টি অভিযোগ আমরা পেয়েছি৷ তার মধ্যে বেশি ছিল, ইভ্যালি- দারাজের বিরুদ্ধে৷ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাজার হাজার দরখাস্ত পড়তে শুরু করে৷ আমি এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হিসেবে অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম জানি না৷ কিন্তু সেই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ এসেছে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা এখন আরও বড় আইনের আওতায় আছে৷ বাইরে নেই, জেলে আছে৷ তারপরও কিন্তু আমরা সেই অভিযোগগুলো রেখে দিয়েছি৷ তারা ফেরত আসার পর যদি কিছু করতে পারি৷ ৩০ জুন পর্যন্ত যে অভিযোগ ছিল তার ৮৭ ভাগ কিন্তু আমরা নিষ্পত্তি করে দিয়েছি৷ এখন যেহেতু প্রতিষ্ঠান বন্ধ, মালিক কারাগারে ফলে আমাদের কিছু করার নেই৷
প্রতিবার রমজান মাস আসলেই নিত্য পন্যের মূল্য আকাশ ছোঁয়া হয় যায়৷ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই? না-কি সুযোগ থাকলেও আপনারা কিছু করছেন না?
আবারও বলি, এই অধিদফতরের কর্মকর্তাদের শুক্রবার নেই, শনিবার নেই প্রতিনিয়ত মাঠে থাকতে হয়৷ সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আমরা কাজ করছি৷ করোনার সময় অনেকদিন সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণা ছিল৷ সেই সময়ও আমাদের লোকজন এমনকি আমি নিজেও মাঠে ছিলাম৷ আপনি দেখে থাকবেন, বিগত দুইটি রোজাতে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল না৷ সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, টিসিবি তৎপর ছিল৷ ভোক্তাদের কষ্ট লাঘব করতে যা যা করা দরকার সেটা করা হয়েছে৷ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিন্তু প্লেনে করে পেঁয়াজ এনে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে৷ আমি জানি না, এর চেয়ে আর কিভাবে ভোক্তার কাছে পৌঁছতে পারব?
আর কী পদক্ষেপ নিলে ভোক্তাদের স্বার্থ আরও বেশি সংরক্ষিত হতে পারে?
একজন ব্যবসায়ীর যেমন দায়িত্ব আছে, একজন ভোক্তারও দায়িত্ব আছে৷ যখন গ্রাহক বা ভোক্তা নিজে বুঝবেন কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার চুক্তিবদ্ধ হওয়া উচিত আর কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নয় তখন তিনি কম প্রতারিত হবেন৷ আমি বাজারে গিয়ে পণ্য শুধু কিনলেই হবে না, আমাকে দেখতে হবে ওই পণ্যটির মেয়াদ আছে কি নেই৷ দেখে শুনে বুঝে পণ্যটি কিনতে হবে৷ বিশেষ করে অনলাইনের ক্ষেত্রে ওদের দেওয়া টার্ম এন্ড কন্ডিশনগুলো জেনে বুঝে পণ্যটি কিনতে হবে৷